উৎসবে বই পাবে চাকমা মারমা ত্রিপুরা শিশুরা
মাতৃভাষায় বই পড়তে চায় অন্যান্য ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীরাও
প্রকাশঃ ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ ০৯:০৬:২৩
| আপডেটঃ ১৩ জানুয়ারী, ২০২৫ ০১:১৯:৩৭
|
৭০৯
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। প্রতিবছরের মতো এবারো বছরের প্রথমদিন (১ জানুয়ারি) উদযাপিত হবে বই উৎসব। বই উৎসবের মধ্যদিয়ে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ পাবে কেবলমতি শিশুরা। এদিন সারাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিকস্তরের শিক্ষার্থীদের মাঝে বিনামূল্যে বই বিতরণ করবে সরকার। তবে সারাদেশের চেয়ে দেশের পার্বত্য অঞ্চলের বই উৎসবের উচ্ছ¡াস অনেক বেশিই। কারণ পাহাড়ে সাধারণ পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুরাও পাবে নিজ মাতৃভাষায় বই। তবে পাহাড়ের তিন ভাষাভাষী শিশুরা মাতৃভাষায় বই পেলেও তঞ্চঙ্গ্যা, বম, ¤্রাে ও পাংখোয়াসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর শিশুরা মাতৃভাষায় পড়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিশিষ্টজন-শিক্ষাবিদরাও পাহাড়ের সকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের মাতৃভাষায় পাঠদান নিশ্চিতের জন্য সরকারকে তাগাদা দিচ্ছেন।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে রাঙামাটির দশ উপজেলায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় প্রাক-প্রাথমিকে প্রতিজনে দুইটি বই করে ১৫ হাজার ৮২০টি, প্রথম শ্রেণীতে প্রতিজনে তিনটি বই করে ২২ হাজার ৪১৬টি, দ্বিতীয় শ্রেণীতে প্রতিজনে তিনটি বই করে ২২ হাজার ৬৩৫টি ও তৃতীয় শ্রেণীতে প্রতিজনে একটি বই করে ৬৮৭৯টি বই বিতরণ কর হবে। মোট ২৯ হাজার ৮০৬ শিক্ষার্থী ৬৭ হাজার ৭৫০টি মাতৃভাষার বই পাবে। অফিস সূত্রে আরো জানা গেছে, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে সাধারণ শিক্ষায় রাঙ্গামাটির দশ উপজেলায় প্রাক-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ৮৯ হাজার ১৫০ জন শিক্ষার্থী ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৫২৯টি বই পাবে। জেলায় বর্তমানে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা ৭০৭টি। তবে এনজিও, কিন্ডারগার্ডেন, পরীক্ষণ বিদ্যালয়সহ মোট প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১ হাজার ৬৪টিতে দাঁড়িয়েছে।
বিভিন্ন প্রাথমিক বিদ্যালয় ও মাতৃভাষার শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, সরকারের এই উদ্যোগের ফল শুধুমাত্র তিন জাতিগোষ্ঠীর শিশুরাই পাচ্ছেন। তবে দক্ষ প্রশিক্ষকের অভাবে যারা পড়তে পাচ্ছেন তারাও ভালোভাবে শিখতে পারছেন না। তাই শিক্ষকদেরও আরো প্রশিক্ষকের প্রয়োজন দরকার। অন্যদিকে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ছাড়াও অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর শিশুরাও মাতৃভাষায় পড়তে চায়।
রাঙামাটির বিশিষ্টজন ও প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত ১১টি জাতিগোষ্ঠীর সকলেই সমান অধিকার ভোগের দাবিদার। সরকার কোন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে শুধুমাত্র ৫ জাতিগোষ্ঠীর ভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠা করার পর যে নিশ্চুপতার দায়িত্ব পালন করছে; এটি আমার কাছে বোধগম্য নয়। যেহেতু পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যার সমাধানের জন্য চুক্তিতেও এখানকার জাতিগোষ্ঠীসমূহের ভাষার অধিকার নিশ্চিত করার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ রয়েছে, তাই তার যথাযথ অনুসরণ সময়ের দাবি।
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান বলেন, আদিবাসী শিশুদের জন্য সরকার মাতৃভাষায় পাঠদানের উদ্যোগে নেওয়ার বিষয়টি আমরা সানন্দে গ্রহণ করেছি। কিন্তু সেটি যদি কেবল বই বিতরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়, তাহলে হওয়ার মতো কিছুই হবে না। পড়ানোর জন্য সবার আগে জানাশোনা ও প্রশিক্ষিত শিক্ষক দরকার, না হলেও এই উদ্যোগ কার্যকর হবে না। একটি স্কুলে দু-একজন চাকমা-মারমা কিংবা ত্রিপুরা শিক্ষকরেখেও তো হবে না, যদি সবাই পড়তে না পারে। তাই আমরা বলব যাদের পড়ানো হচ্ছে তারা যেন ভালোভাবে পড়তে পারে, কেবল বই বিতরণের মধ্যে আটকে না থেকে। আর অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর যে সকল শিশুরা আছে তাদেরও বঞ্চিত না করে শিগগিরই সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়া দরকার।
এদিকে, জানতে চাইলে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার (ডিপিইও) মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ২০২৩ শিক্ষাবর্ষে রাঙ্গামাটির দশ উপজেলার ৮৯ হাজার ১৫০জন শিশু বই উৎসবের মধ্যদিয়ে ৩ লাখ ৭৬ হাজার ৫২৯টি নতুন বই পাবে। এছাড়া চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর ২৯ হাজার ৮০৬ জন শিশু ৬৬ হাজার ২৫০টি মাতৃভাষার বই পাবে। মূলত সরকার ২০১৭ সাল থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুদের প্রাক-প্রাথমিক থেকে মাতৃভাষায় পাঠ্যপুস্তক দিচ্ছে। ক্রমান্বয়ে এখন তৃতীয় পর্যন্ত শিশুরা মাতৃভাষায় বই পাচ্ছেন। ৫টি মাতৃভাষায় বই দেওয়া হলেও পাহাড়ে চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা শিশুরা বই পাচ্ছে। অন্যান্য যেসকল ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিশুরা রয়েছে তাদের মাতৃভাষায় পাঠদানে সরকারের ইতিবাচক ভাবনা রয়েছে বলেও জানান তিনি।
তিনি আরো জানান, ইতোমধ্যে জেলার প্রতিটি উপজেলায়-উপজেলায় বই পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। উচ্ছ¡াসের মধ্যদিয়ে বই উৎসব সম্পন্ন করতে সার্বিক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী ১ জানুয়ারি সারাদেশের সঙ্গে একযোগে রাঙ্গামাটিতে জেলাতেও বই উৎসব হবে। এদিন সকাল ১০টায় জেলা শহরের বনরূপা মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উৎসবের উদ্বোধন করবেন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান। দুপুর ১২টায় রাণী দয়াময়ী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বই উৎসবের উদ্বোধন জেলাপ্রশাসক।
প্রসঙ্গত, ২০১৭ সাল থেকে দেশে সংখ্যায় কম হিসাবে ‘ক্ষুদ্র জাতিসত্তার’ জনগোষ্ঠীর শিশুদের মাতৃভাষায় পড়াশোনার জন্য বই বিতরণ করে আসছে সরকার। শুরু থেকেই চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, গারো, এবং সাদ্রিÑ এই পাঁচটি ভাষায় বই বিতরণ শুরু হলেও পাহাড়ের তিন জেলা রাঙামাটি-খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের বসবাসরত চাকমা, মারমা ও ত্রিপুরা ভাষাভাষি শিশুরা প্রাক-প্রাথমিক বই পাচ্ছে। পরবর্তীতে ২০১৮ সালে প্রথম শ্রেণী, ২০১৯ সালে দ্বিতীয় শ্রেণী ও ২০২০ সালে তৃতীয় শ্রেণীতেও মাতৃভাষায় বই বিতরণ কার্যক্রম শুরু করে সরকার। সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, কেবল তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্তই মাতৃভাষায় পড়তে পারবে দেশের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর শিশুরা।