বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। দু-দিকে বিস্তীর্ণ পাহাড়। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে একলেনের সড়ক। সড়ক দাঁড়ালে মনে হবে দুদিকে দুই বিস্তীর্ণ জনপদ। পথে-পথে আছে মানুষের ঘরবাড়ি। যে সড়কের পথ ধরে গেলেই দেখা মেলে মেঘ-পাহাড়ের উপত্যকাখ্যাত কাক্সিক্ষত সাজেক ভ্যালি। ২০১৩-১৪ সালে রাঙামাটির সাজেকের রুইলুই পাহাড়ে পর্যটনকেন্দ্র গড়ে তোলার পর এর জনপ্রিয়তা ছড়িয়েছে সারাদেশে। সাজেকে এসে মেঘ দেখতে ছুটে আসছেন বিদেশীরাও। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে অত্যধিক গাড়ির যাতায়াত, অদক্ষ চালক, বেপরোয়া গতি ও আঁকাবাঁকা ঝুঁকিপূর্ণ সড়ক ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন চলাচলের কারণে সাজেকের সড়কে মড়ক দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের হিসাবে গত একবছরে সাজেক-বাঘাইহাট সড়কে ৩০টির অধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে। তন্মধ্যে বিগত ৫দিনে চারটি ঘটনায় একজন নিহত ও প্রায় ১০ জন হতাহত হয়েছেন। এর আগে বিগত মাসে হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। তবে ইতোমধ্যে সড়কটিতে ঝুঁকিরোধে প্রশস্তকরণের উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে বলে জানায় কর্তৃপক্ষ।
সাজেক থানা পুলিশ জানায়, সম্প্রতি গত ২২ ডিসেম্বর পৃথক দুটি দুর্ঘটনায় ৪ জন আহত হন। ২৩ ডিসেম্বর এক মোটরসাইকেল আরোহী পর্যটক নিহত ও আরেকজন আহত হন। ২৬ ডিসেম্বর সড়ক দুর্ঘটনায় ৪ জন আহত হয়েছে। এর আগে গত ১৭ আগস্ট চিপ উল্টে দুজন নিহত হয়েছেন। সর্বশেষ গত ১০ জানুয়ারী একজন মোটর সাইকেল আরোহী নিহত হয়েছে। পুলিশ বলছে, বেপরোয়া গতি ও অদক্ষ চালকের কারণে বেশিরভাগ ঘটনা ঘটছে।
জানতে চাইলে সাজেক থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ নূরুল হক জানান, গত ২২ ডিসেম্বর থেকে ১০ জানুয়ারী পর্যন্ত এই আঠারোদিনে সাজেকে পাঁচটি সড়ক দুর্ঘটনার ঘটেছে। এসব ঘটনায় একজন মোটরসাইকেল চালকসহ প্রায় ১০ জন আহত হয়েছেন। ইদানিংকালে সাজেকের পথে সড়ক দুর্ঘটনা বেড়েছে। আমরা সাজেক যাওয়া-আসা গাড়িগুলোকে একলেনে চলাচলের নির্দেশনা দিলেও অনেকেই সেটি মানছেন না। এছাড়া আঁকাবাঁকা-উঁচুনিচু সড়ক ও অদক্ষ্য চালকের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে।
সাজেক কটেজ মালিক সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি চাইথোয়াই অং চৌধুরী জানান, সাজেকে প্রকৃতি উপভোগ করতে আসা পর্যটকের সংখ্যা বাড়ছে। যে কারণে এই সড়কটি প্রশস্তকরণ এখন সময়ের দাবি। সাজেক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অতুলাল চাকমা জানান, সাজেকে পর্যটক আসার হার দিন দিন বাড়ছে। বিভিন্ন সময়ে সড়ক দুর্ঘটনা খবর আমরা পাচ্ছি। দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সরকারের কাছে সড়কটি প্রশস্তকরণের দাবি জানাচ্ছি।
দীর্ঘ আড়াই দশক ধরে খাগড়াছড়ির দীঘিনালায় সাংবাদিকতা করেছেন জাকির হোসেন। বর্তমান সময়ে সাজেকের সড়কে মড়কের কারণ হিসাবে বেশকিছু পর্যবেক্ষণের কথা তুলে ধরেছেন তিনি। সাংবাদিক জাকির হোসেন বলেন, শুরুর দিকে যখন বাঘাই-হাট সাজেক সড়কটি নির্মিত হয় তখন এ সড়কে খুব-বেশি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু দিনদিন সড়কটির সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ হলেও দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। এটির প্রধানত কারণ হলো একলেনের এই সড়কটিতে সাজেকগামী ও ফেরতআসা গাড়িগুলো বেপরোয়া গতিতে চলাচল ও অদক্ষ চালকের কারণে দুর্ঘটনা বেড়েছে। তন্মধ্যে সড়কের বিভিন্নস্থানে পর্যটনরা গাড়ির পাকিং করে থাকেন যা এই সড়কে গাড়ী চলাচলে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। আগে যেখানে সাজেকে ১৫০-২০০ গাড়ি যাতায়াত করতো সেখানে এখন ৫০০ অধিক গাড়ি প্রতিদিন যাতায়াত করে থাকে। যে কারণে এই সড়কে যানবাহনের বাড়তি চাপ সৃষ্টি হয়েছে। বিগত এক বছরে ৩০টির অধিক সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে।
এদিকে, সড়ক নির্মাণের কাজে জড়িত বেশকয়েকজন প্রকৌশলী জানিয়েছেন, মূলত সাজেকের রুইলুই পাহাড়চূড়া নিচে ২ কিলোমিটার এলাকাতেই বেশিরভাগ সময়ে দুর্ঘটনা ঘটছে। উঁচ-নিচুু ও আঁকা-বাঁকা রাস্তায় ফিটনেসবিহীন গাড়িগুলো বিভিন্ন সময়ে ব্রেকফেল করে থাকে আবার সড়কে চলাচলকারী চালকরা অনেকাংশে অদক্ষ ও বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানোর কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। সমতল থেকে আসা ট্যুরিস্ট বাইকাররাও পাহাড়ি সড়কে চলাচলে দক্ষ না হওয়ায় বাইকের স্পিড কনট্রোল করতে না পারাতে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁকেও দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। এজন্য ঝুঁকিপূর্ণ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও সড়ক প্রশস্তকরণ জরুরি।
দীঘিনালা-সাজেক সড়ক রক্ষনাবেক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক মেজর এইচএম ইকরামুল হক জানান, এই সড়কটি ২০১৩ সালে চালু হয়েছে, পুরো সড়কের দৈর্ঘ্য ৪৫ কিলোমিটার। বর্তমানের একলেনের সড়কটির প্রশস্ত ৫ দশমিক ৫ মিটার। আমাদের এই সড়কটি দুইলেনের করার জন্য একটি প্রস্তাবনা করা হয়েছে। দুইলেনের সড়ক হলে সড়কটি ৭ দশমিক ৯ মিটার প্রশস্তকরণ করা হবে। প্রকল্পটির অধীনে সড়কের ৭টি স্থানে যে সাতটি বেইলি ব্রিজ রয়েছে, সেগুলোতে আরসিসি ব্রিজ করা হবে। এতে করে সড়ক দুর্ঘটনায় অনেকাংশে রোধ করা যাবে। মেজর ইকরামুল বলেন, বিভিন্ন সড়কে বৃষ্টিপাতের কারণে সড়কে মাটিধস ও ব্রিজের গোড়ার মাটি সরে যায়, তখন আমরা দ্রুততম সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করি।
রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক মিজানুর রহমান জানান, সাজেক-বাঘাইছড়ি উপজেলা সদর থেকে অনেক দূরে। সেখানে প্রতিনিয়ত প্রশাসনিক কার্যক্রম পরিচালনা করা কঠিন। তবে এই সড়কে দুর্ঘটনা প্রতিরোধে আমরা পদক্ষেপ নিচ্ছি।