রবিবার | ২২ ডিসেম্বর, ২০২৪

সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে নিরাপদ পানির সংকট মোকাবেলায় অ্যাওয়ার্ড পেলো রাঙামাটি জেলা পরিষদ

প্রকাশঃ ২১ নভেম্বর, ২০২২ ০৬:১৬:২২ | আপডেটঃ ২০ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৬:২৭:৩১  |  ৬৪৮
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পার্বত্য অঞ্চলে শুস্ক মৌসুমে প্রায় শুকিয়ে যায় পাহাড়ী জনপদের বিভিন্ন পানির উৎস ছড়া খাল ও কুয়া গুলো। ছড়া, খাল  শুকিয়ে যাওয়ার কারণে দারুন পানির কষ্টে পড়তে হয় পার্বত্য জনপদে দুর্গম এলাকার বসবাসকারী জনগোষ্ঠীকে। তখন নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে পার্বত্য এলাকার নারীদের ছুটতে হতে মাইলের পর মাইল। আর সৌর বিদ্যুতের মাধ্যমে  নিরাপদ পানির সংকট কাটায় আর্ন্তজাতিক পর্যায়ে আ্যাওয়ার্ড পেলো রাঙামাটি জেলা পার্বত্য পরিষদ। 

জানা গেছে, রাঙামাটির জুরাছড়ি উপজেলার প্রত্যন্ত ইউনিয়ন বনযোগীছড়া। এই ইউনিয়নে নিরাপদ পানীয় জলের সংকট দীর্ঘদিনের। জলবায়ু বিপর্যয় ও ক্রমবর্ধমান খরার কারণে বিগত দুই দশকে এই সংকট আরো প্রকট আকার ধারণ করেছে। সুপেয় পানির পাশাপাশি ও ব্যবহার্য নিরাপদ পানির একমাত্র ভরসা কেবল ঝিরি বা ছড়ার পানি। প্রত্যন্ত এলাকার মানুষ ঝিরির পানি ব্যবহারের ফলে প্রায়শই গ্রামের শিশু ও বয়স্কদের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে পানিবাহিত রোগের দেখা দিতো। তবে এখন এই ইউনিয়নের কিছু এলাকার নিরাপদ পানির সংকট কমেছে। সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে ভূ-গর্ভস্থ পানি ব্যবহারের ফলে এলাকার মানুষের নিরাপদ সুপেয় পানির সংকট ঘুচলো। এছাড়া রান্না-বান্না ও পরিবারিক কাজেওও অনেকক্ষেত্রেই সুফলভোগী হয়েছে পাঁচ গ্রামের ১৭৩টি পরিবার।

পাড়াবাসী ও প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে, জুরাছড়ি উপজেলার বনযোগীছড়া ইউনিয়নের ধুলকুল ও পাঁচপতিমা ছড়া জলবায়ু সহনশীল কমিটির আওতাধীন স্থানীয় পাঁচটি পাহাড়ি গ্রাম রয়েছে। বাদল পাড়া, লহ্মী মেম্বার পাড়া, এমকে পাড়া, চৌমুহনী পাড়া ও চেয়ারম্যান পাড়া নামের এই পাঁচটি গ্রামে ১৭৩টি পরিবার বসবাস করে আসছেন। মোট জনসংখ্যাও হাতেগোনা ৭৭৫ জন। স্থানীয় অধিবাসীদের সুপেয় ও ব্যবহার্য নিরাপদ পানির সংকট নিরসনে পার্বত্য চট্টগ্রাম জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পের অধীনে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ ও ডানিডা’র যৌথ উদ্যোগে ১২ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয়ে সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয় ২০১৮ সালের শেষদিকে। এই প্রকল্পে সরকারিভাবে ১০ লাখ টাকা ও স্থানীয় পাড়াবাসীর থেকে ২ লাখ ৭ হাজার টাকা ব্যয় বাজেট ধরা হয়েছে। প্রকল্পটির মাধ্যমে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে জমা রাখা হয় বড় ট্যাংকে। আবার সেই ট্যাংক থেকে পাইপলাইনের মাধ্যমে ট্যাপকল দিয়ে পানি সংগ্রহ করছেন স্থানীয়রা।

এদিকে, প্রকল্পটি স্থানীয় ‘ধুলকুল ও পাঁচপতিমা ছড়া জলবায়ু সহনশীল কমিটির (সিআরসি)’ মাধ্যমে বাস্তবায়িত হয়েছে। এই সিআরসি কমিটির ১১ জন সদস্যের মধ্যে ৭ জনই নারী। এছাড়া পুরো প্রকল্পটি বাস্তবায়নে স্থানীয় নারীদের অংশগ্রহণ অগ্রাধিকার পেয়েছে। চলতি বছরে মিশরে অনুষ্ঠিত কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে বাংলাদেশসহ চারটি দেশ স্থানীয় অভিযোজন চ্যাম্পিয়ানস্ অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছে। সেখানে ডানিডার অর্থায়নে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের এই প্রকল্পটি ‘স্থানীয় নারীদের কমিউনিটিতে নেতৃত্বাধীন উদ্যোগের’ জন্য পুরষ্কৃত হয়েছে। পুরষ্কার হিসেবে ১৫ হাজার ইউরো প্রাইজমানি পেয়েছে বাংলাদেশ।

মিশরের বিখ্যাত অবকাশ কেন্দ্র শার্ম আল শেখে ৬-১৮ নভেম্বর ২০২২ পর্যন্ত  অনুষ্ঠিত বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে কপ২৭ গ্লোবাল সেন্টার অন এডাপটেশান এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রফেসর পেট্টিক ভারকুইজন ১২ নভেম্বর রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদকে ৪টি ক্যাটাগরির মধ্যে  Inclusive leadership category তে চ্যাম্পিয়ান ঘোষণা করে একটি সম্মাননা স্মারক রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের প্রতিনিধি অরুনেন্দু ত্রিপুরার হাতে তুলে দেন। এসময় বাংলাদেশের বন, পরিবেশ এবং জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক মন্ত্রী জনাব শাহাব উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন।

৪টি ক্ষেত্রে নির্বাচনে জুরি বোর্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব বান কি মুন, মিশরের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বিষয়ক মন্ত্রী রানিয়া এ আল মাশহাত, বাংলাদেশের ক্লাইমেট ভালনারাবিলিটি ফোরামের থিমেটিক এমব্যাসেডার সাইমা ওয়াজেদ পুতুল, ভারতের এসপিআরএসসি পরিচালক শীলা পাতেল এবং গ্লোবাল সেন্টার অন এডাপটেশান এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা প্রফেসর প্যাট্টিক ভারকুইজন।

প্রকল্পটির সুবিধাভোগী জোনা চাকমা, সুফল চাকমা ও বিষু রাণী চাকমা জানান, জুরাছড়ি উপজেলাটি হ্রদবেষ্ঠিত হলেও তাদের সুপেয় পানির সংকট ছিলো। এখন সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পাম্প দিয়ে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে। এর জন্য গ্রামের মানুষ অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। দীর্ঘদিন পর এখানকার মানুষের নিরাপদ পানির দুর্ভোগ কেটেছে। তবে এখানে ফসলি জমিতে পানির অভাবে বছরে একবারের বেশি আবাদ করা যায় না। এক্ষেত্রে সেচ ব্যবস্থাপনার মিললে অর্থনৈতিকভাবে গ্রামের মানুষ উপকৃত হবেন বলে তারা জানিয়েছেন।

সুপেয় পানির সুব্যবস্থার প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় নারী ইউপি সদস্য নোনাবি চাকমা জানান, বিগত দুই দশক ধরে এখানকার মানুষ পানীয় জলের সংকটে সবচেয়ে বেশি ভুগছেন। ছড়ার কূয়া থেকে এক কলসী পানি আনতে কয়েকঘন্টা সময় লেগে যায়। সারাদিনের একটা বড় সময় পানি সংগ্রহের কাজে ব্যয় হতো। এখন নিরাপদ পানির পাওয়ার সহজলভ্যতায় স্থানীয় নারীদের দুর্ভোগ লাঘব হয়েছেন। এখন পরিবারিককাজে নারীরা আরো বেশি মনোযোগী হতে পারবেন।

ধুলকুল ও পাঁচপতিমাছড়া জলবায়ু সহনশীল কমিটির (সিআরসি) সভাপতি সন্তোষ বিকাশ চাকমা জানান, পাহাড়ে দিনদিন পানির উৎস কমে যাচ্ছে। ক্রমবর্ধমান খরা ও জলবায়ু বিপর্যয়ের ফলে ঝিরি-ঝর্নাগুলোও শুকিয়ে যাচ্ছে। এখানকার মানুষেরা  দীর্ঘ সময় করে ধরে বসবাস করে আসছেন। এতদিন ঝিরির পানি পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করতেন। যেসব পানি নিরাপদ না হওয়ার ফলে বিভিন্ন সময়ে পানিবাহিত রোগের দেখা দিতো। এখন সৌর বিদ্যুৎ ব্যবস্থার মাধ্যমে নিরাপদ পানির সুব্যবস্থা হয়েছে। বনযোগীছড়া ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামের মানুষ সুবিধাভোগী হয়েছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রাম জলবায়ু সহনশীল প্রকল্পের জেলা কর্মকর্তা পলাশ খীসা জানান, জলবায়ুর বিপন্নতা নিরুপণের লক্ষ্যে আমাদের সীমিত বাজেটের মধ্যদিয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিরাপদ সুপেয় পানির সংকট নিরসনের জন্য কাজ করেছি। বনযোগীছড়া স্থানীয় পাঁচটি পাড়ার মানুষ এই উদ্যোগের সুবিধাভোগী হয়েছেন। আগে যেখানে কষ্টসাধ্য করে ঝিরি পানির ব্যবহার করতে হতো সেখানে এখন তারা সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে নিরাপদ পানি সরবরাহ করতে পারছেন। পুরো কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে স্থানীয় নারীরা সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার পেয়েছেন।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী জানান, জলবায়ু বিপর্যয়ের কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকায় পানি সংকটের ভয়াবহতা প্রকট আকারে ধারণ করেছে। জলবায়ুর সঙ্গে ভারসাম্যতা বজায় রেখে রাঙামাটির দুর্গম এলাকায় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে সুপেয় পানির সংকট নিরসনে রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ উন্নয়ন সংস্থার ডানিডার সঙ্গে একত্রিত হয়ে কাজ করছে। প্রকল্পটির অধীনে জুরাছড়ির বনযোগীছড়ায় সৌরবিদ্যুতের মাধ্যমে পানির পাম্প ব্যবহার করে ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলন করে স্থানীয়দের পানির সংকট সমাধান করা হয়েছে। এতে স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের দীর্ঘদিনের সংকট থেকে পরিত্রাণ পেয়ে এখন খুশি। এছাড়া ইতোমধ্যে ডানিডার সঙ্গে আমাদের এই যৌথ প্রকল্পটি এবারের কপ-২৭ জলবায়ু সম্মেলনে স্থানীয় কমিউনিটিতে নারীর নেতৃত্বাধীন অংশগ্রহণের জন্য পুরষ্কৃত করা হয়েছে।


রাঙামাটি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions