মঙ্গলবার | ১৯ মার্চ, ২০২৪

কাপ্তাই হ্রদের ছোট মাছে বড় আয়

প্রকাশঃ ১০ অক্টোবর, ২০২২ ০৬:৫৫:০২ | আপডেটঃ ১৯ মার্চ, ২০২৪ ০৪:১৭:২৯  |  ৯৯৫
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। ষাটের দশকে প্রমত্তা কর্ণফুলী নদীতে জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যেই কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদের সৃষ্টি। প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর আয়তনের বিশালাকার জলাধারের কাপ্তাই হ্রদ এখন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় স্বাদু পানিতে মাছ চাষের বৃহৎক্ষেত্র।

মূলত জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনে লক্ষ্যে এই হ্রদের সৃষ্টি হলেও এটি এখন দেশের মৎস্যসম্পদ উৎপাদনে ভূমিকা রেখে আসছে। একটা সময়ে হ্রদে বড় প্রজাতি কিংবা কার্পজাতীয় মাছের উল্লেখজনক উৎপাদন হলেও কালের বিবর্তনে এটি এখন পুরো বিপরীত। যে কারণে হ্রদ হতে আহরিত মাছ থেকে যে শুল্কহার বা রাজস্ব আদায় করে থাকে সরকার সেটি এখন মূলত ছোট প্রজাতির মাছ থেকেই। ছোট মাছেই এখন বড় আয় করছে সরকার।

রাঙামাটির আট উপজেলা ও খাগড়াছড়ির দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। তবে রক্ষণাবেক্ষণ ও মাছ চাষের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএফডিসি)। সরকারি এই প্রতিষ্ঠানটির বাৎসরিক প্রজাতিভিত্তিক মৎস্য বিররণীতে কাপ্তাই হ্রদ হতে ছোট-বড় মোট ৪৪ প্রজাতির মাছ আহরণের তথ্য রয়েছে। তথ্যানুযায়ী, ৪৪ প্রজাতির মাছের মধ্যে আকারে ২৭ প্রজাতির বড় মাছ ও ১৭ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। তবে প্রজাতিভিত্তিক ছোট মাছের সংখ্যা কম হলেও হ্রদ হতে আহরিত মাছের মধ্যে ছোট প্রজাতির মাছের আধিক্য বেশি। যে কারণে কাপ্তাই হ্রদ হতে বিএফডিসির শুল্ক আয় হচ্ছে মূলত ছোট প্রজাতির মাছ থেকেই বেশি।

বার্ষিক মৎস্য অবতরণ ও শুল্ক আদায়ের হিসাব পর্যালোচনা করে দেখা গিয়েছে, বিএফডিসির রাঙ্গামাটির প্রধান বিপণনকেন্দ্র, কাপ্তাই, মহালছড়ি ও মারিশ্যা- এই চার অবতরণকেন্দ্রে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭ হাজার ৬০৭ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৭ হাজার ৯৫৩ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৮ হাজার ১০৪ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ৪৫৫ টন ও সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬ হাজার ১৫৪ টন। তন্মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৭ দশমিক ৩৭ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯২ দশমিক ৬৩ শতাংশ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৬ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৩ দশমিক ৮৩ শতাংশ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৫ দশমিক ৩৩ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৪ দশমিক ৬৭ শতাংশ, ২০২০-২১ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৪ দশমিক ৪৪ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৫ দশমিক ৫৬ শতাংশ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে বড় প্রজাতি ৫ দশমিক ২৫ শতাংশ ও ছোট মাছ ৯৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

এ পাঁচ অর্থবছরের মধ্যে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১২ কোটি ৪২ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১২ কোটি ৭৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১২ কোটি ৩৬ লাখ ও সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ১১ কোটি ৬৮ লাখ টাকা শুল্ক বা রাজস্ব আদায় আদায় করেছে বিএফডিসি। তবে এখানে প্রায় ৯০ শতাংশের ওপরে শুল্ক আদায় হয়েছে ছোট প্রজাতির মাছ হতেই। তবে কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় বা বড় প্রজাতির মাছের আধিক্য বাড়াতে প্রতিবছরই নিয়মতান্ত্রিকভাবে মাছের পোনা ছেড়ে যাচ্ছে বিএফডিসি। একই সময়কালীন বা বিগত পাঁচ বছরের পোনা অবমুক্তকরণের হিসাব বলছে, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ২৭ টন; ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৯; ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৪৩; ২০২০-২১ অর্থবছরে ৪৬ ও সবশেষ ২০২১-২২ অর্থবছরে ৬০ টনের অধিক পোনামাছে ছাড়া হয়েছে। তবে পোনা মাছ অবমুক্তকরণ বাড়লেও বড় মাছের উৎপাদন ক্রমেই নিম্নগামী।

যদিও এনিয়ে জেলে, মৎস্য কর্মকর্তা ও গবেষকরা বলছেন, হ্রদে পোনা ছেড়ে পূর্বের সময়মতো কার্পজাতীয় মাছের স্বাভাবিক উৎপাদন অনেকটাই অসম্ভব। প্রথমত হ্রদে প্রতি বছরের পহেলা মে থেকে তিনমাস মাছ ধরা বন্ধ করা হলেও পোনা অবমুক্তকরণ করতে করতে একমাস চলে যায়। জুন-জুলাই এই দুমাসে অবমুক্ত করা পোনা ৯ ইঞ্চির অধিক বেড়ে ওঠার সুযোগ হয়ে ওঠেনা। আবার আগে হ্রদের প্রাকৃতিক প্রজননকেন্দ্রস্থল সমূহে এখন নষ্ট হয়ে যাওয়ার ফলে প্রাকৃতিক প্রজননবন্ধ প্রায়। যে কারণে বিশালাকার কাপ্তাই হ্রদে অবমুক্ত করা পোনা হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে যথেষ্ট নয়। অন্যদিকে হ্রদে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহারে নিয়মতান্ত্রিক নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বিএফডিসির কার্যকর মনিটরিংয়ের অভাবে ছোট ফাঁসের জাল ব্যবহার কমানো যাচ্ছে না।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটির ব্যবস্থাপক লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, কাপ্তাই হ্রদে বড় প্রজাতির কিংবা কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন বাড়াতে বিএফডিসি আন্তরিকভাবে কাজ করছে। বিগত বছরগুলোতে হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের পোনা অবমুক্তকরণ ক্রমাগত বেড়েছে। আমাদের নিজস্ব হ্যাচারিতে পোনা উৎপাদনও করে যাচ্ছি। সবশেষ এই মৌসুমে আমরা রেকর্ড সংখ্যক পোনা অবমুক্ত করেছি। যদিও অনেকেই অভিযোগ, লেকে বড় মাছ নেই। লেকে বড় মাছ নেই, বিষয়টি সঠিক নয়। সাধারণত লেক থেকে আহরিত বড় প্রজাতির মাছগুলো স্থানীয় বাজারে চলে যায়। যে কারণে লোকাল বাজারে বড় মাছ পাওয়া গেলেও বিএফডিসির অবতরণকেন্দ্রে বড় মাছ আসে না। অন্যদিকে প্রাকৃতিক প্রজননস্থলের মধ্যে চেঙ্গী ও রীংক্ষ্যং চ্যানেলে প্রাকৃতিক প্রজনন হচ্ছে না।

বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের বাজারজাতকরণ কর্মকর্তা মো. শোয়েব সালেহীন বলেন, বিএফডিসির শুল্ক আদায়ের বেশির ভাগই হয়ে থাকে ছোট প্রজাতির মাছ থেকে। বিশেষত কেচকি, চাপিলা ও মলাসহ অন্যান্য ছোট মাছের আধিক্য রয়েছে কাপ্তাই হ্রদে। তাই ছোট প্রজাতির মাছ বেশি পাওয়ার কারণে বিএফডিসি ছোট প্রজাতির মাছ থেকে বেশি রাজস্ব আদায় করছে।


প্রসঙ্গত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃত্রিম জলাধার রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদ। এটি বাংলাদেশের পুকুরসমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। ১৯৬১ সালে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এ হ্রদের সৃষ্টি হলেও মৎস্য উৎপাদন ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। মৎস্য অধিদপ্তরের হিসাবে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ির প্রায় ২৫ হাজার জেলে মৎস্য আহরণের মধ্য দিয়ে জীবিকানির্বাহ করে আসছে।


অর্থনীতি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions