সিএইচটি টুডে ডট কম, বান্দরবান। বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলা সদরের কেন্দ্রীয় জেতবন বৌদ্ধ বিহারের প্রয়াত বিহারাধ্যক্ষ ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ষষ্ঠতম সংঘরাজ ভদন্ত বিচারিন্দ মহাথেরোর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছে। এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে জাতীয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া উদযাপন কমিটি।
শুক্রবার (২৯ মার্চ) দুপুরে বৌদ্ব বিহার প্রাঙ্গনে রাখা প্রয়াত ভিক্ষুর মরদেহের কফিন ধর্মীয় রীতিতে সম্মান জানিয়ে অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানের জন্য বিহারের নিকটে তৈরি করা অস্থায়ী মাঠে নেয়া হয়। এসময় ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের ঐতিহ্য অনুয়ায়ী ব্রঃও (গোলা বাজি) ফুটানো হয়। অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠানে অংশ নেন বান্দরবানসহ রাঙ্গামাটি ও খাগড়াছড়ির চার শতাধিক বৌদ্ধবিহারের প্রধান ভিক্ষুগণ ও তিন পার্বত্য জেলার বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী লাখো মানুষ। শনিবার শেষ হয় অনুষ্ঠান।
আয়োজক কমিটির জানায়, এ অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে আর্থিক সহযোগিতা দিয়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি বীর বাহাদুর উশৈসিং। বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্যশৈহ্লা, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান অংশৈপ্রæ, খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মংশৈপ্রæ, বান্দরবান রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মেহেদি হাসান। ব্যক্তি ও পারিবারিক পর্যায়সহ আরো সহযোগিতা করেছেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন সংগঠন ও পাড়া কেন্দ্রিক সমাজের দায়ক দায়িকাবৃন্দ। এছাড়া অনুষ্ঠান সফল করতে সুপেয় খাবার পানি দান করেছে বান্দরবান প্রেসক্লাবসহ নানা সংগঠন ও ব্যক্তিবর্গ।
কমিটি জানায়, ভদন্ত বিচারিন্দ মহাথেরো গতবছর ১৭ আগস্ট দেহত্যাগ করেন। এরপর তার মরদেহ কফিনে রেখে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী সংরক্ষণ করা হয়। গত শুক্রবার দুপুর ২টায় প্রয়াত ভিক্ষুর কফিন অন্ত্যোষ্টিক্রিয়ার জন্য তৈরি করা মাঠে নেয়া হয়। মাঠে তৈরি করা দয়ইং হ্রোওয়ে ত্লাদ এ (বাঁশ, কাঠ, সুতা, পেরেক, রঙিন ও বাহারি কাগজ দিয়ে তৈরি করা সুসজ্জিত অবকাঠামোয় মাটি থেকে কমবেশি পাঁচ ফুট উচ্চতার মেঝে ও তার উপর করা দোলনা) ভিক্ষুর কফিন রাখা হয়। এরপর কফিনবাহী সুসজ্জিত য়ইং (দোলনা) ঘিরে তরুণীরা পালাক্রমে ধর্মীয় গানের সঙ্গে ঐতিহ্যবাহী সাস্কৃতিক য়ইং নৃত্য করেন। ২৯ ও ৩০ মার্চ দুই দিনের অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত রীতি অনুযায়ী সইং নৃত্য অবিরত রাখতে হয়। রীতি পালন করতে ১৩ টি সইং নৃত্য দল এতে অংশ নেয়। একইসঙ্গে করা হয় সংস্কৃতির দলীয় সইং নৃত্য। এ অনুষ্ঠানে ২৭টি সইং দল অংশ নেয়।
শনিবার (৩০ মার্চ) বিকালে য়ই হ্রোওয়ে ত্লাং থেকে মুইতয় ত্লাংয়ে (য়ইং হ্রোওয়ে ত্লাং এর মতো তৈরি করা ভিন্ন নকসায় বৌদ্ধ বিহারের আদলে সুসজ্জিত অবকাঠামো) কফিন স্থানান্তর করা হয়। এ ত্লাং এর নিচে জ্বালানী কাঠ রাখা হয়। মুইতয় ত্লাং এর উদ্দেশ্যে কমবেশি ১০০ ফুট দৈর্ঘ্যের এমএস তারে ঝুলানো ডুংসিতে (বাঁশ দিয়ে তৈরি করা বারুদ বাজি) আগুন ধরিয়ে দিলে ডুংসি স্বয়ংক্রিয়ভাবে মুইতয় ত্লাং এ গিয়ে বিস্ফোরিত হয়। একে একে দেড় হাজার ডুংসি বিস্ফোরিত হতে হতে আগুন ধরে মুইতয় ত্লাং ও কফিনটি প্রকৃতির মধ্যে বিলীন করে দেওয়ার মধ্য দিয়ে সমাপ্ত হয় অন্ত্যোষ্টিক্রিয়া অনুষ্ঠান। এটি বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ বলে জানায় কমিটি।
ভদন্ত বিচারিন্দ মহাথেরো ১৫ বছর বয়সে তিনি গৃহীজীবন ত্যাগ করে শ্রমণ হিসেবে প্রবজ্যা গ্রহণ করেন। ২২ বছর বয়সে ভান্তে জীবনে দীক্ষা নেন। এর পর ততকালীন বার্মায় (বর্তমান মিয়ানমার) রাজধানী ইয়াঙ্গুন শহরে ধর্মীয় উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ করেন। ভান্তে জীবনে তিনি থেরো, মহাথেরো ও পার্বত্য চট্টগ্রামে ষষ্টতম সংঘরাজ উপাধি অর্জন করেন। ভান্তে জীবনে ৬৮ বছর ওয়া (বষার্বাস বা বছর) লাভ করেন।
গত বছর ১৭ আগস্ট তারিখে তিনি ৯০ বছর ৬ মাস বয়সে ইহ জীবন ত্যাগ করেন। ভদন্ত বিচারিন্দ মহাথের ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহনের পর হতে রোয়াংছড়ি কেন্দ্রীয় জেতবন বৌদ্ধ বিহারে বিহারাধ্যক্ষ হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। রোয়াংছড়ি পাড়ার মৃত উষাজাই মারমা ও মৃত মাথুই মারমাদর ৪ ছেলে ও ১ মেয়ের মধ্যে তিনি চতুর্থ সন্তান ছিলেন।