শনিবার | ৩০ নভেম্বর, ২০২৪

বাঘ নেই বাঘাইছড়িতে, তবুও আতংকে স্থানীয়রা

প্রকাশঃ ০৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৩ ০৮:৩৮:০৩ | আপডেটঃ ৩০ নভেম্বর, ২০২৪ ০৯:৩০:৫৬  |  ২৫৯৫
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা রাঙামাটির বাঘাইছড়ি। এই উপজেলার একটি ইউনিয়ন হলো ৩০ নম্বর সারোয়াতলী ইউনিয়ন। সারোয়াতলী ইউনিয়নের চিন্তারাম ছড়া নামের একটি পাহাড়ি এলাকায় রয়েল বেঙ্গল টাইগারের (বাঘ) উপস্থিতি দেখা গেছে বলে দাবি করছে স্থানীয়রা। গতকাল সোমবার (৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে ওই এলাকার যৌথখামার গ্রামের বাসিন্দা বিদ্যাধন চাকমা’র একটি গরুকে আক্রমণ করে আহত করেছে বাঘসদৃশ ওই প্রাণিটি। সন্ধ্যা থেকে এই খবরটি স্থানীয়ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে গোটা এলাকা জুড়ে। যদিও বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন বন বিভাগ ও বাঘ বিশেষজ্ঞরা।

বন কর্মকর্তা ও বাঘ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে পাহাড়ি এলাকায় বাঘ দেখার কথা বলা হচ্ছে- সেখানে বাঘের অস্তিত্ব পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যে প্রাণিটি পালিত গরুকে আক্রমণ করেছে সেটি বাঘসদৃশ অন্য কোনো প্রাণি হতে পারে। তবে অবশ্য কোনোভাবে রয়েল বেঙ্গল টাইগার নয়।

৩০ নম্বর সারোয়াতলী ইউনিয়ন পরিষদ  এর সাবেক চেয়ারম্যান তুষার কান্তি চাকমা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ‘বিষয়টি শোনার পরে তিনি সেখানকার স্থানীয় কার্বারির সঙ্গে কথা বলেছেন। কার্বারি তাকে জানিয়েছেন, মাঝারি সাইজের বাঘের মতো একটা প্রাণীকে জঞ্জলে দেখা গিয়েছে। স্থানীয় এক ব্যক্তির একটি গরুকেও জখম করেছে প্রাণিটি। ওই এলাকায় বনের আশপাশের লোকজন আতঙ্কিত হয়ে আছেন।’

বাঘাইছড়িতে বাঘ দেখার ‘উড়ো খবরে’ অনেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে পোস্ট করেছেন। এতে করে খুব অল্প সময়ে ‘বাঘ দেখার’ খবর ছড়িয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম জুড়ে। বাঘাইছড়ি উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নের বাসিন্দা জুপিটার চাকমা বাপ্পী বলেন, ‘সোমবার দুপুরে বিদ্যাধন চাকমার একটি গরুকে আক্রমণের খবর পেয়েছি। এর আগেও সারোয়াতলী বনে (পাবলাখালী বনপ্রাণী অভয়ারণ্য) স্থানীয়রা বাঘের ডাক শুনেছেন বলে জানিয়েছেন।’

যদিও যৌথখামার গ্রামের যে বাসিন্দার পালিত গরুকে আক্রমণ করা করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে; সেই বিদ্যাধন চাকমা’র সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়নি। তিনি আদতে কী ধরণের প্রাণি দেখেছেন তাই সেটিও নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না।

পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের অধীনেই রয়েছে কাচালং সংরক্ষিত বন। কাচালং সংরক্ষিত বনের একটি অংশ রয়েছে বাঘাইছড়ির উপজেলার সারোয়াতলী ইউনিয়নে। ‘পাবলাখালী বনপ্রাণী অভয়ারণ্য’ ও ‘পাবলাখালী গেইম সেঞ্চুয়ারি রেঞ্জ’ নামের কাচালং সংরক্ষিত বনের এই অংশটির দায়িত্বে রয়েছে বন বিভাগের পাবলাখালী রেঞ্জ।

পাবলাখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা সজীব কুমার মজুমদার বলেন, ‘স্থানীয়রা সারোয়ারতলী এলাকায় বাঘ দেখার কথা বললেও এটি সত্য হওয়ার সম্ভাবনা নেই। বন বিভাগ ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থার (আইইউসিএন) যৌথ উদ্যোগে পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে ছয় মাস আগেও ১৮টি ক্যামেরা লাগানো হয়েছিল। কিন্তু ওই ক্যামেরা বিভিন্ন প্রাণির গতিবিধি ধরা পড়লেও বাঘের কোনো অস্তিত্বে মেলেনি। যদি সত্যিই বাঘ থাকে তাহলে একটির ক্যামেরায় হলেও ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘ বছর পর বাঘ দেখার কথাটি বলা হলেও বাঘসদৃশ কিছু হতে পারে। যা দেখে মানুষ বাঘ বলছেন।’

সজীব মজুমদার আরও বলেন, ‘যদি বাঘ থেকেই থাকে সেক্ষেত্রে একটি বাঘ থাকবে না, একাধিক বাঘ থাকবে। নারী বাঘের পাশাপাশি পুরুষ বাঘ এবং একটা সার্কেলও থাকবে। আর এতগুলো বাঘ থাকলেও বনের আশপাশের মানুষ সেটি অহরহ’ই দেখা ও আক্রমণের শিকার হওয়ার কথা।’

জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘বাঘ মানে তো আমরা চিনি কিংবা জানি রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পাবলাখালীর বনে রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার সম্ভাবনা নেই। ডোরাকাটা বাঘের অস্তিত্ব এখানে নেই। স্থানীয় মানুষ যে প্রাণিটির কথা বলছেন সেটি চিতা বাঘ কিংবা মেজো বিড়ালও হতে পারে। আর যদি গরুকে আক্রমণ করাও হয়ে থাকে তাহলে এই ছোট প্রাণিতো গরুকে আক্রমণ করার কথা না। আমরা যদি প্রাণিটিকে দেখতে পেতাম তাহলে হয়তো নিশ্চিত করে বলা যেতে প্রাণিটি আসলে কী ছিল।’

২০২১ সালে বন অধিদপ্তর ও আন্তর্জাতিক প্রকৃতি সংরক্ষণবিষয়ক সংস্থার (আইইউসিএন) সমন্বয়ে বাঘাইছড়ি উপজেলার কাচালং সংরক্ষিত বনে বাঘের খোঁজে গিয়েছিল বাঘ ও বন্যপ্রাণী বিশেষজ্ঞদের একটি দল। ওই বিশেষজ্ঞ দলের নেতৃত্বে ছিলেন বাঘ বিশেষজ্ঞ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান। মনিরুল এইচ খান বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই বাঘ নিয়ে গবেষণা করে আসছেন।

পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলায় বাঘের অস্তিত্ব আছে কীনা- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মনিরুল এইচ খান জানান, ‘আমরা কাচালং সংরক্ষিত বন ও পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে গবেষণার জন্য গিয়েছিলাম। তবে সেখানে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও গবেষণা করে দেখা গেছে কাচালং সংরক্ষিত বনে বাঘের অস্তিত্ব থাকার সম্ভাবনা থাকলেও পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বাঘ থাকার কোনো সম্ভাবনা নেই।’

এই বাঘ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, গবেষণা করে আমরা দেখেছি বাঘাইছড়ির সংরক্ষিত বনে চিতা বাঘ, মেজো বাঘসহ দুই প্রজাতির ভাল্লুক রয়েছে। মায়া ও সম্বর হরিণ নামের দুই প্রজাতির বুনো হরিণ রয়েছে। পাবলাখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে বাঘ দেখার কথা বলা হলেও সেটি চিতা বাঘ, মেজো বাঘা কিংবা অন্য কোনো প্রাণি হতে পারে বলে ধারণা করছেন এই বাঘ বিশেষজ্ঞ।

প্রসঙ্গত, এক সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে বাঘের অস্তিত্ব ছিল বলে দাবি করে আসছেন স্থানীয়রা। বাঘের অস্তিত্ব থেকেই রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে বলেও প্রচলিত একটি ধারণা রয়েছে। তবে বিগত কয়েক দশকেও সরাসরি কেউ বাঘ দেখেনি বাঘাইছড়ির কোনো বনে। তবে বাঘ বিশেষজ্ঞরা দাবি করছেন রাঙামাটির বাঘাইছড়ির কাচালং সংরক্ষিত বনে এক সময়ে যে বাঘের বিচরণ ছিল সেই অস্তিত্ব মেলেছে।


রাঙামাটি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions