শুক্রবার | ২৯ মার্চ, ২০২৪

খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের কাউন্সিলে ‘দিদার-অপু’কে ঘিরেই’ নতুন মুখের পদধ্বনি !

প্রকাশঃ ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ ০১:০৭:০২ | আপডেটঃ ২৮ মার্চ, ২০২৪ ১২:৩৬:১৪  |  ৪৩২২
বিশেষ প্রতিনিধি, খাগড়াছড়ি। খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের আসন্ন কাউন্সিলে নেতৃত্বে নতুন মুখের পদধ্বনি উঁকি দিচ্ছে। দলের আগামী জাতীয় কাউন্সিলের আগেই দীর্ঘ সাত বছর পর বহুল প্রত্যাশিত খাগড়াছড়ি জেলা আওয়ামীলীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। নেতাকর্মীদের আশা আগামী অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহেই সেই শুভক্ষণ নির্ধারিত হতে পারে।
জেলার নয়টি উপজেলার মধ্যে চারটি উপজেলার সবকটি ইউনিয়নে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোটাভোটির মাধ্যমে নেতৃত্ব নির্বাচনের ফলে পাল্টে গেছে হিসেব-নিকেশ। এরমধ্যে দীঘিনালা উপজেলা ছাড়া পানছড়ি ও মহালছড়ি উপজেলার কাউন্সিলে হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতায় নেতৃত্বে এসেছে পরিবর্তন। মানিকছড়িতে তারুণ্যের চাপে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় কাউন্সিল বৈতরণী পার হয়েছেন বিনা প্রতিদ্বন্ধীতায় নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যান মো: জয়নাল আবেদীন ও সম্পাদক মো: মাঈন উদ্দিন। পানছড়ি’র উপজেলা কাউন্সিলে টাকার ছড়াছড়ি ছিল চোখে পড়ার মতো।
একইভাবে সদর, মাটিরাঙা, রামগড় এবং লক্ষ্মীছড়ি উপজেলাতেও ভোটাভোটির মাধ্যমে উপজেলা নেতৃত্ব নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছেন জেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী।

আওয়ামীলীগের বিভিন্ন স্তরের নেতা ও কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলা আওয়ামীলীগের নেতাদের অধিকাংশই বয়োবৃদ্ধ। তবে তরুণদের তুলনায় তাঁদের ইমেজ তৃণমূলে বেশ ভালোই।

বেশ কয়েকজন প্রবীন নেতা এই প্রতিবেদককে বলেন, তরুণদের একটি অংশ বৈধ-অবেধ ব্যবসা-বাণিজ্যের মাধ্যমে আখের গোছানোর ধান্ধায় ব্যস্ত। রাজনৈতিক জ্ঞান-গরিমাতেও পিছিয়ে। ফলে দলটির ভবিষ্যত দেখভালের জন্য আদর্শিকভাবে দৃঢ় নেতৃত্বের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে।
দলের ভেতরে যেনো পরিবারতন্ত্র ভর করতে না পারে সেজন্য আগামী জেলা কাউন্সিলে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী প্রত্যক্ষ ভোটের দিকেই সবার আগ্রহ বলে মত ব্যক্ত করেছেন জেলা আওয়ামীলীগের পোঁড় খাওয়া নেতা মনির হোসেন খান।

এ অবস্থায় স্থানীয় সংসদ সদস্য ও জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা মেধাবীদের নেতৃত্বের অনুসন্ধানে মনোযোগী হয়েছেন। প্রয়োজনে তিনি জেলার নয়টি উপজেলা থেকে নেতৃত্ব সংগঠিত করার উদ্যোগ নিতেও পিছপা হবেন না বলে জানিয়েছেন।

আর তারুণ্যনির্ভর এই পরিবর্তনে ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করছেন দলের জেলা পর্যায়ের বেশিরভাগ নীতি নির্ধারক। নিজেদের মধ্যে মত-দ্বিমত থাকলেও ‘দুষ্ট গোয়ালের চেয়ে শূন্য গোয়ালকে’ই শ্রেয় মনে করছেন উপজেলা নেতারাও। একুশ শতকের উপযোগী দক্ষ নেতৃত্বের স্বার্থে দলের অন্যান্য প্রবীন নেতারাও তরুণদের প্রতি ক্রমশ: আস্থাশীল হয়ে উঠছেন। কারণ, টানা তিন মেয়াদে সরকার গঠনের ফলে দলের তৃণমলের নেতাকর্মীদের সাথে উপজেলা ও জেলার শীর্ষ নেতৃত্বের সাথে প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির বড়ো গড়মিল তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে দলের দু:সময়ের ত্যাগীদের বাদ দিয়ে চরম আনুগত্যশীল ও দলে নবাগতদের ‘অটো প্রমোসন’ দেয়ার ফলে দলের সাংগঠনিক কর্মকান্ডে সাধারণ কর্মী ও সমর্থকদের অনাগ্রহ দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে। একই সাথে দলের কিছু কিছু নেতার হঠাৎ ‘আঙুল পুলে কলা গাছ’ বনে যাওয়া এবং রাতারাতি নিজেদের ‘লাইফস্টাইল’ পাল্টিয়ে ফেলাকেও সাধারণ মানুষ ভালো চোখে দেখছে না।

দলের বেশিরভাগ সাংগঠনিক তৎপরতায় প্রবীনদের মধ্যে এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ছাড়াও সিনিয়রদের মধ্যে সাবেক জেলা সভাপতি নুরনবী চৌধুরী, দলের দীর্ঘ সময়ের ত্যাগী নেতা বীর মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম, পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, সাবেক চেয়ারম্যান চাইথোঅং মারমা, জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম সহ-সভাপতি মনির হোসেন খান ও কল্যাণ মিত্র বড়–য়া, ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী, সাবেক মেয়র মংক্যচিং চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক এম. এ. জব্বার ও এড. আশুতোষ চাকমা, সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মো: শানে আলমকেই ঘুরেফিরে দেখা যায়।

অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সবকটির কমিটির মেয়াদ চলে গেছে অনেক আগেই। ফলে এই সংগঠনগুলোর সভাপতি-সম্পাদকের মধ্যে বিরাজ করছে বিদায় বেলার আমেজ। দু’চারজন ছাড়া বাকী নেতাদের দেখা মেলে অমাবস্যা-পূর্ণিমার মতোই।দলের জেলা কমিটির পঁচাত্তর সদস্য এবং একুশজন উপদেষ্টার বেশিরভাগই নিষ্ক্রিয়।

দলের তরুণ অংশের মধ্যে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি মংসুইপ্রু চৌধুরী অপু, সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক জুয়েল চাকমা, সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো: দিদারুল আলম, সদর উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি খোকনেশ^র ত্রিপুরা ও জেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সভাপতি পার্থ ত্রিপুরা জুয়েল, সাবেক ছাত্রনেতা বিশ^জিত দাশকেই বেশি সক্রিয় দেখা যায়। সাংগঠনিক শক্তিমত্তার দিকেও তাঁরা বেশ এগিয়ে।

খাগড়াছড়ি জেলায় আওয়ামীলীগের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের নীতিতে দলের গুরুত্বপূর্ন পদগুলোতে পাহাড়ি-বাঙালি, প্রবীন-নবীন এবং সকল সম্প্রদায়ের সম-অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার প্রবণতা লক্ষনীয়। সেই সমীকরণে আগামী জেলা সম্মেলনে বর্তমান সভাপতি ও সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা সভাপতি পদে আগ্রহী হলে তাঁর সাথে একজন বাঙালিই সা: সম্পাদক হবার সম্ভাবনা শতভাগ। সভাপতি পদে যদি এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা অনাগ্রহী কিংবা কাউকে ছাড় দেন তাহলে সেই পদেও একাধিক প্রার্থী হবার বিষয়টি নেতাকর্মীদের মুখে মুখে।

সেক্ষেত্রে সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা, বীর মুক্তিযোদ্ধা রণ বিক্রম ত্রিপুরা, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কংজরী চৌধুরী, সাবেক সভাপতি নুরনবী চৌধুরী, সাবেক জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান চাইথোঅং মারমা এবং অধ্যক্ষ সমীর দত্ত চাকমা’র প্রার্থী হওয়ার খবর জানা গেছে। কারণ, ২০১২ সালের ১১ নভেম্বর অনুষ্ঠিত জেলা কাউন্সিলে কংজরী চৌধুরী ও নুরনবী চৌধুরী ছাড়া বাকীরা সবাই প্রতিদ্বন্ধীতা করেছিলেন।
সাধারণ সম্পাদক পদে কে কে প্রার্থী হবেন, এ বিষয়ে কেউ সরাসরি নেতাকর্মীদের কাছে জানান দিচ্ছেন না কৌশলগত কারণে। নিজেদের নানা সীমাবদ্ধতার কারণে তাঁরা প্রায় সবাই সংসদ সদস্যের কাঁধের ওপর ভর করেই পাড়ি দিতে আগ্রহী। তারপরও এখন পর্যন্ত মনির হোসেন খান, দীঘিনালা উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি হাজী মো: কাশেম, মানিকছড়ি উপজেলার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এম. এ. জব্বার, মাটিরাঙা পৌর মেয়র ও উপজেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি মো: শামছুল হক, জেলা আওয়ামীলীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক মংসুইপ্রু চৌধুরী এবং জেলা আওয়ামীলীগের শিক্ষা ও মানব সম্পদ বিষয়ক সম্পাদক মো: দিদারুল আলমের নাম আলোচনায় রয়েছে।

উর্পযুক্ত প্রার্থীদের মধ্যে শেষের দুইজনকে সামগ্রিক বিবেচনায় বেশ শক্তিশালী প্রার্থী মনে করছেন পুরো জেলার আওয়ামী ঘরানার বিভিন্ন পেশাজীবিরাও। দলে, বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠান এবং প্রশাসনের সাথে এই দুই জনের ঘনিষ্ঠ সম্পৃক্ততা দৃশ্যমান। দুইজনেরই ঘরগুণে কপাল পোড়ার আশংকা রয়েছে। শেষতক দুইজনই জেলা আওয়ামীলীগের বেশ ভালো পদে আসীন হবেন, এটা প্রায় নিশ্চিত। তবে, সেই নেতৃত্বে বিবেচনায় থাকবে বয়স এবং পারিবারিক ঘরানাও। এরমধ্যে এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা, সভাপতি পদের জন্য আগ্রহী হলে ভাতিজি জামাই হিসেবে যেমন বাদ পড়তে পারেন অপু চৌধুরী, একই সাথে ২০১৫ সালের পৌর নির্বাচনকে ঘিরে সাংগঠনিক নিয়ম-শৃঙ্খলার প্রশ্ন উঠলে বাদ পড়তে পারেন, দিদারুল আলমও।

জেলা আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নির্মলেন্দু চৌধুরী নিজের সম্পাদক পদে প্রার্থী হবার অনাগ্রহের কথা উল্লেখ করেই বলেন, বড়ো দল হিসেবে দীর্ঘ সময় টানা ক্ষমতায় থাকার কারণে নতুনের সংখ্যা বেড়েছে। তাই নতুনদের জায়গা তো দিতেই হবে।

তিনি দাবি করেন, বর্তমান সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র নেতৃত্বে জেলায় আওয়ামীলীগ অনেক বেশি সাধারণ মানুষের আস্থা অর্জন করেছে।
জেলা আওয়ামীলীগের অন্যতম সহ-সভাপতি মনির হোসেন খান বলেন, তিনি (এমপি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা) এর আগে ২০০৫ সালে বিরোধীদল থাকাকালে অনুষ্ঠিত জেলা আওয়ামীলীগের কাউন্সিলে সভাপতি হবার সুবর্ণ সুযোগ দলের বৃহত্তর স্বার্থে প্রবীন নেতা যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরাকে ছাড় দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ২০০৬ সালে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা দলের সংসদ সদস্য প্রার্থী হবার মনোনয়ন পেলেও সে নির্বাচন বাতিল হলে ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সময়কালের নির্বাচনে যতীন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এই সময়কালে সকল মান-অভিমান ভুলে কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা খাগড়াছড়ি আওয়ামীলীগের সকল নেতাকর্মীদের কাছে নিজের অবস্থান সংহত করে নিয়েছেন।

তিনি দাবি করেন, আসন্ন জেলা কাউন্সিলে ইউনিয়ন-উপজেলার মতো গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কাউন্সিলরদের ভোটেই নেতৃত্ব নির্বাচনকে অগ্রাধিকার দেয়া হবে। কারণ, তৃণমূল সেটিই প্রত্যাশা করে।

খাগড়াছড়ি থেকে নির্বাচিত দুইবারের সংসদ সদস্য ও বর্তমান জেলা সভাপতি কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা’র রাজনীতির বয়স দুই দশকের অধিক। বিগত ‘২০০১ থেকে ২০০৫ সাল’ পর্যন্ত বিএনপি-জামাত শাসনামলে খাগড়াছড়িতে দু:সহ দু:সময় নেমে এসেছিল। সেসময় তিনি সর্বশক্তি দিয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে আসীন হন। একবার পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়া ছাড়াও তিনি বর্তমানে প্রতিমন্ত্রী পদ-মর্যাদায় শরণার্থী টাস্কফোর্স-এর চেয়ারম্যান।

তিনি জানান, পাহাড়ি-বাঙালি সবার কাছে আওয়ামীলীগকে শক্তিশালী করতে হলে অসাম্প্রদায়িক নেতৃত্বের বিকল্প নেই। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী-জননেত্রী শেখ হাসিনার এই অঙ্গীকারের প্রতি আমরাও শ্রদ্ধাশীল। তাই আগামী জেলা কাউন্সিলে দলের বৃহত্তর স্বার্থ এবং ভবিষ্যতের ভালোর জন্য প্রয়োজনে নিজের দলীয় পদ ছাড়তে হলে, তাতেও প্রস্তুতি রয়েছে তাঁর।

তিনি আসন্ন জেলা সম্মেলনে বিশেষ কারো প্রতি কোন প্রকার অনুকম্পা বা বিরাগ না থাকার যুক্তিতে বলেন, দল ভালো নেতা পেলেই সাধারণ মানুষ এবং কর্মীরা ভালো থাকবেন। তাই ছাড় দেয়ার মানসিকতা সম্পন্ন নেতৃত্বকেই স্বাগত জানাতে চাই।

পাহাড়ের রাজনীতি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions