সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। দীর্ঘ ২৪ বছরেও পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়িত না হওয়া এবং সরকারসহ অন্যান্য সংস্থাগুলোর একের পর এক চুক্তি লংঘন এবং চুক্তি বিরোধী ও জুম্ম স্বার্থ পরিপন্থী নানা ষড়যন্ত্র ও কার্যক্রমের কারণে পাহাড়ী সম্প্রদায়ের জাতীয় অস্তিত্ব চরম হুমকির সম্মুখীন। গত জুন থেকে আগষ্ট মাসে ১৮টি মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৬ জন খুন, শিশুসহ ৬ জন আহত, ১২ জন অপহরণের ঘটনা ঘটেছে।
আজ সোমবার সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি থেকে প্রকাশিত পার্বত্য চট্টগ্রামের মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির কেন্দ্রীয় সহ-তথ্য ও প্রচার সম্পাদক সজীব চাকমার পাঠানো মানবাধিকার পরিস্থিতির উপর প্রতিবেদনে বলা হয়, পাহাড়ী সম্প্রদায়ের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা তীব্র এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছে। সরকার ও বহিরাগত গোষ্ঠীর নির্মম ও নির্দয় ঔপনিবেশিক ও সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসনের কবলে পড়ে পাহাড়ী জনগণের সাধারণ মানবাধিকার ও মৌলিক অধিকারসহ রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং ভূমি ও ভূখন্ডের অধিকার আজ প্রতিনিয়ত পদদলিত হয়ে চলেছে। সরকার একদিকে চুক্তি বাস্তবায়ন বন্ধ রাখাসহ চুক্তি বিরোধী নানা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করে চলেছে, বিভিন্ন সংস্থা জনসংহতি সমিতিসহ পার্বত্য চুক্তি বাস্তবায়নে আন্দোলনকারী অধিকারকর্মী ও জনগণকে সুপরিকল্পিতভাবে অপরাধী (সন্ত্রাসী ও চাঁদাবাজ) হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের বিনাবিচারে হত্যা ও আটক, মিথ্যা মামলা দিয়ে জেলে প্রেরণ, মারধর, হয়রানি, হুমকি প্রদানের কার্যক্রম জোরালোভাবে চালিয়ে যাচ্ছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, জুন থেকে আগষ্ট মাসে নারী ও শিশুর উপর ৭টি যৌন ও শারীরিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে ৭জন পাহাড়ী নারী সহিংসতার শিকার হয়েছে। তার মধ্যে ১ জনকে দলগত ধর্ষণসহ ২ জন পাহাড়ী নারীকে ধর্ষণ এবং ১ জনকে হত্যার চেষ্টাসহ ৪ নারী ধর্ষণের চেষ্টা এবং ১ জন হত্যার শিকার হয়েছে। এছাড়া বহিরাগতদের কর্তৃক ধর্ষণ ও ধর্ষণের চেষ্টার শিকার হয়েছে ৪ জন নারী এবং আওয়ামীলীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ৫ জন নেতাকর্মী কর্তৃক সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় এক কলেজ ছাত্রী। লংগদুতে একজন স্কুল শিক্ষিকাকে কারা গলা কেটে হত্যা করা হয়েছে। বম পার্টি নামে খ্যাত কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) সন্ত্রাসীরা বিলাইছড়ির বড়থলিতে একটি ত্রিপুরা পাড়ায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে নিরীহ ৩ জন গ্রামবাসীকে হত্যা ও ২ শিশুকে গুরুতর জখম এবং তার পরবর্তীতে বড়থলি ও রোয়াংছড়ির আলেক্ষ্যং ইউনিয়নের প্রত্যক্ষ অঞ্চল থেকে তঞ্চঙ্গ্যা ও ত্রিপুরাদের একশ এর অধিক জুমচাষী পরিবারকে উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়া বান্দরবানে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ভূমিদস্যুদের কর্তৃক আগষ্ট মাসে নিজেদের ৪০০ একর জুম ভূমি ও গ্রামীন বন রক্ষার জন্য আন্দোলনরত ১১ জন গ্রামবাসীর নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাতনামা আরো ১৫/২০ জনকে আসামী করে বান্দরবানের সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে এক মামলা দায়ের করা হয়েছে। লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এবং আদিবাসী ম্রো ও ত্রিপুরাদের মধ্যেকার ৪০০ একর ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য আগষ্ট মাসে বান্দরবান জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সভায় লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড কর্তৃক বেদখলকৃত ভূমি উদ্ধার করার পরিবর্তে ম্রো ও ত্রিপুরাদের ৩৯ পরিবারকে পাঁচ একর ভূমি বরাদ্দের পর বাদবাকী ভূমি বেদখলকারী রাবার কোম্পানীকে দেয়ার জন্য পক্ষপাতমূলক প্রস্তাব করেন পার্বত্যমন্ত্রী বীর বাহাদুর ও বান্দরবান জেলা প্রশাসক ইয়াসমিন পারভীন তীবরীজি। ভূক্তভোগী ম্রো ও ত্রিপুরা গ্রামবাসীরা এই তীব্র প্রতিবাদ করেন এবং এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন।
প্রতিবেদনে দাবী করা হয়, উন্নয়ন, কখনো সড়ক ও পর্যটন নির্মাণ, কখনো রাবার বাগান, কখনো বিভিন্ন সরকারি কার্যক্রমের নামে চলছে পাহাড়ীদের বসতবাড়ি থেকে উচ্ছেদ, বসতভূমি ও জুমভূমি বেদখল, বাগান-বাগিচা ধ্বংসকরণ এবং বহিরাগতদের অব্যাহত সাম্প্রদায়িক হামলা ও গুচ্ছগ্রাম সম্প্রসারণের চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়া ইসলামী মৌলবাদীদের কর্তৃক অব্যাহতভাবে চলছে নিরীহ ও দরিদ্র জুম্মজনগণকে সুকৌশলে ইসলামে ধর্মান্তিতকরণ ও তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধ্বংসকরণ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগত অনুপ্রবেশ ঘটছে। ২০২২ সালের জনশুমারীতেও পরিষ্কার ও উদ্বেগজনকভাবে পাহাড়ীদের জনসংখ্যা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাওয়া ও সংখ্যালঘুতে পরিণত হওয়ার চিত্র ফুটে উঠেছে। যা স্পষ্টতই জুম্মদের জাতিগতভাবে বিলুপ্তকরণের ধারাকেই প্রতিফলিত করেছে।