কাপ্তাই হ্রদে মাছ আহরণে ঘাটতি, বার্ষিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শঙ্কা
প্রকাশঃ ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২৩ ০৪:৪২:৪৯
| আপডেটঃ ০৮ জানুয়ারী, ২০২৫ ০৫:০৪:১৯
|
৬৪১
বিশেষ প্রতিনিধি , সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পানিস্বল্পতার মধ্য দিয়েই শুরু আহরণ মৌসুম। যার ফলে মৌসুমের শুরুর দিকে কাপ্তাই হ্রদে স্বল্পপানির কারণে মাত্রাতিরিক্ত মাছ ধরা পড়ে। কিন্তু মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই মাছের আহরণ উল্লেখজনকহারে কমে গেছে। হ্রদের মাছ আহরণ কমায় বিপাকে পড়েছেন জেলে-ব্যবসায়ীরা। মাছ আহরণ কমতির ফলে বিএফডিসি’র বার্ষিক মৎস্য অবতরণের যে লক্ষ্যমাত্রা তা বিপর্যয়ের কারণে রাজস্ব আয় নিয়েই শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বার্ষিক ১৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আদায় হয়েছে এখন পর্যন্ত মাত্র সাড়ে ৯ কোটি টাকা। আবার সাড়ে ৯ কোটি টাকার মধ্যে ৩ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে নিয়মিত খরচে। বিএফডিসির বিগত অর্থ বছরের তুলনায় চলতি অর্থ বছরে সব প্রজাতির মাছের উপর ২০% শতাংশ শুল্ক হার বেড়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সরকারের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা পূরণের জন্য কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণন কেন্দ্রকে তাগাদা দিয়েছে মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গত ৩১ জানুয়ারি বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) এক চিঠিতে প্রতিষ্ঠানটির অধীনস্থ কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্রেকে লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী বার্ষিক আয় অর্জনের জন্য নির্দেশনা দিয়েছে। বিএফডিসির হিসাবনিয়ন্ত্রক মো. রাজিবুল আলমের সই চিঠিতে বলা হয়েছে, কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্র্র রাঙামাটিকেন্দ্রের ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২২ মাসের আয়-ব্যয় প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায় কেন্দ্রের বার্ষিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ১৯ কোটি সাড়ে ৬৭ লাখ টাকার বিপরীতে প্রথম ৬ মাসে কেন্দ্রে রাজস্ব আয় হয়েছে ৯ কোটি ৫১ লাখ টাকা মাত্র। যা বার্ষিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্যমাত্রার শতকরা ৪৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ অর্জন মাত্র। লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় রাজস্ব অর্জন তুলনামূলক অনেক কম। অপরদিকে, কেন্দ্রের একইসময়ে ব্যয় হয়েছে ৩ কোটি টাকা। যার ফলে ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই থেকে ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত কেন্দ্রের অপারেশনাল লাভ হয়েছে ৬ কোটি ৫১ লাখ টাকা মাত্র। ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে কেন্দ্রের বার্ষিক আয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযাযী রাজস্ব আয় অর্জনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে যথাযথ কর্তৃপক্ষ কর্তৃক নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে ওই চিঠিতে।
বিএফডিসি সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের ৯ হাজার টন মাছ অবতরণের লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। তবে গত বছরের ১৮ আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত সাড়ে ৫ মাসের অধিক সময়ে ৪ হাজার ৭০৯ টন মাছ বিএফডিসি রাঙামাটির চারটি অবতরণ কেন্দ্রের মাধ্যমে বাজারজাত করা হয়েছে। যা বিএফডিসির মোট অবতরণ লক্ষ্যমাত্রার ৫২ দশমিক ৩৩ শতাংশ। মূলত প্রতি অর্থবছরের আগস্ট থেকে পরের বছরের এপ্রিল পর্যন্ত; নয় মাসকে মাছ আহরণের মৌসুম ধরা হয়। কিন্তু বিগত সাড়ে ৫ মাসে লক্ষ্যমাত্রার অর্ধেক মাছ পাওয়া গেলেও বাকী তিনমাসে অবতরণ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
জেলে ও মৎস্য ব্যবসায়ীরা বলছেন, মৌসুমের প্রথমদিকে হ্রদের আশানুরূপভাবে মাছ আহরিত হলেও শেষের দিকে হ্রদে পানিস্বল্পতা ও মাছের পরিমাণ কমে যাওয়ার ফলে মাছ আহরণে ভাটা পড়ে। সে কারণে বিএফডিসির লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী এবারের মাছ আহরণ হবে না। রাঙামাটি জেলা মৎস্য ব্যবসায়ী সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক উদয়ন বড়ুয়া জানান, ‘পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃষ্টিপাত না হওয়ায় কাপ্তাই হ্রদে পর্যাপ্ত বাড়েনা। যে কারণে আহরণ মৌসুমের শুরুর দিকে মাত্রাতিরিক্ত মাছ আহরণ হওয়ায় শেষের দিকে আহরণে ভাটা পড়ে। এছাড়া আগের চেয়ে বর্তমানে জেলে পরিবারের সংখ্যা বেড়েছে। মৌসুম শুরুতে প্রতিদিন ১৫-২০টি মাছবাহী ট্রাক রাজধানীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেলেও বর্তমানে ৪-৫টি মাছ নিয়ে যাচ্ছে। মাছ উৎপাদনের জৌলুস ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনে বছরে দুইবার মাছ আহরণ বন্ধ রাখা দরকার।’
জানতে চাইলে কাপ্তাই হ্রদ মৎস্য উন্নয়ন ও বিপণনকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক লেফট্যানেন্ট কমান্ডার মো. তৌহিদুল ইসলাম জানান, কাপ্তাই হ্রদের পানির পরিমাণ আশঙ্কাজনকভাবে কমে যাচ্ছে, এতে করে মাছ আহরণেও ভাটা পড়ছে। এভাবে পানি কমতে থাকলে পুরো এপ্রিল পর্যন্ত মাছ আহরণ চালু রাখতে রাখব কী-না সেটি নিয়ে শঙ্কায় আছি। যদি বৃষ্টিপাত হয় তাহলে অবস্থার পরিবর্তন হতে পারে, অন্যথায় শঙ্কা রয়েছে। মাছ অবতরণ ও রাজস্ব আয় প্রসঙ্গে ব্যবস্থাপক বলেন, ‘গত বছরের তুলনায় আমাদের ৪০ টন মাছ কম অবতরণ হয়েছে, তবে ইদানিং অবতরণ কিছুটা বাড়ছে। আমাদের বার্ষিক অবতরণ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ না হলে রাজস্ব আয় অর্জন নিয়ে শঙ্কা রয়েছে।’
প্রসঙ্গত, দেশের বৃহত্তম বদ্ধ জলাশয়ের মধ্যে অন্যতম কাপ্তাই হ্রদের আয়তন প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। ষাটের দশকে রাঙামাটির কাপ্তাইয়ে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের লক্ষ্যে কর্ণফুলী নদীতে বাধ দেয়ায় বিশালাকার কৃত্রিম হ্রদের সৃষ্টি হয়। প্রতি বছরের ১ মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত তিনমাস হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের প্রজনন ও অবমুক্ত করা পোনা মাছের সুষম বৃদ্ধি নিশ্চিত করাসহ প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্যসম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। নিষেধাজ্ঞা শেষে আগস্ট থেকে শুরু হয় মাছ আহরণের নতুন মৌসুম, যা শেষ হয় পরবর্তী বছরের এপ্রিলে। মূলত প্রতি মৌসুমে নয়মাসই মাছ আহরণ করা হয়ে থাকে কাপ্তাই হ্রদে। রাঙ্গামাটির আট উপজেলা ও খাগড়াছড়ির দুই উপজেলা নিয়ে বিস্তৃত এই কাপ্তাই হ্রদে সরকারি হিসাবে প্রায় ২৫ হাজার নিবন্ধিত জেলে পরিবার মাছ ধরাসহ সংশ্লিষ্ট পেশায় জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। কর্ণফুলী নদীতে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্যে এই হ্রদের সৃষ্টি হলেও এটি বর্তমানে সরকারের রাজস্ব আয়ের অন্যতম উৎস।