বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, খাগড়াছড়ি। এই যে রামগড়ে স্থলবন্দর হতে যাচ্ছে; এটির ফলে তো এই জেলার সাথে ভারতের বেশ কয়েকটি রাজ্যের অর্থনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং পারস্পরিক সম্পর্কের নতুন দুয়ার খুলে যাচ্ছে। সূচিত হবে পার্বত্য অর্থনীতির নতুন যুগ। এই স্থল বন্দরের মাধ্যমে দেশের যেকোন অঞ্চলের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও খাগড়াছড়ি জেলা প্রণিধানযোগ্য ভূমিকায় চলে যাবে।
উপরের কথাগুলো বলছিলেন, খাগড়াছড়ির জেলা প্রশাসক মো: রাশেদুল ইসলাম। যিনি আর কয়েক দিন পরই যোগ দেবেন ‘রাজউক’-এর পরিচালক পদে।
পার্বত্য জেলা হিসেবে খাগড়াছড়ির অসামান্য সম্ভাবনার আশা ব্যক্ত করে তিনি বলেন, এখানকার এগ্রো-ফরেস্ট্রি, বন, বৃক্ষ এবং বিপুল অনাবাদী পাহাড় দেশি-বিদেশি বিনিয়োগের একটি উর্বর ক্ষেত্র। এখানকার শক্তিশালী জেলা পরিষদ, পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডকে সাথে নিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় যে গতিতে এগোচ্ছে তাতে অদূর ভবিষ্যতে অপার বিনিয়োগের ক্ষেত্র প্রসারিত হবেই। বিনিয়োগ বাড়লে এখানকার শিক্ষিত, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন ও হস্তশিল্প জানা নারীদের কর্মসংস্থানের পথ প্রশস্ত হবে। তাতে এখানকার অনেক অশান্তি ও অস্তিরতা ঘুচে যাবে।
নিজের দায়িত্ব পালনকালে খাগড়াছড়ি জেলায় অনেক বেশি জাতীয় ও আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের বিরোধ চাঙা হলেও তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পরিস্থিতি মোকাবিলা করেছেন। তাঁর এই চৌকষ দক্ষতার কথা বিনয়ের সাথে পরিহার করে তিনি বলেন, এটি সম্ভব হয়েছে সহকর্মী এবং এখানকার জনপ্রতিনিধি-রাজনীতিক-গণমাধ্যম ও সর্বসাধারণের আন্তরিকতার ফলেই।
যদি কখনো আবারও খাগড়াছড়িতে ফিরে আসেন, সেক্ষেত্রে তাঁর প্রত্যাশার সীমানা সম্পর্কে বলেন, আ¤্রপালিসহ অন্যান্য স্থানীয় ফল উৎপাদন ও সরবরাহের ক্ষেত্রে খাগড়াছড়ি এখন পুরো দেশেই ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে। সরকারের ২০৪১ সালের যে লক্ষ্যমাত্রা, তা পূরণে এই জেলার ভূমিকা ও অবদান অনস্বীকার্য্য হবেই। কারণ এখানকার মানুষের শ্রম-প্রজ্ঞা-মানসিকতা এবং শিক্ষার অগ্রগতি সেটারই ইঙ্গিত বহন করে।
‘একজন জেলা প্রশাসক হিসেবে যখন যেখানে গিয়েছি পরিচয় না পেলেও মানুষ আমাকে অত্যন্ত সহজ ও স্বাভাবিকভাবে নিয়েছে। নিজেকে কখনো পশ্চাৎপদ কোন জেলায় কাজ করেছি বলেই মনে হয়নি। তাই নিজেও মনপ্রাণ উজাড় করেই কাজ করতে পারার এই শান্তি ভবিষ্যতে আমার মতো অন্যসব কর্মকর্তাকেও পেশাগত এবং চাকরি জীবনে আলোর পথ দেখাবে।’
পার্বত্য জেলা হিসেবে খাগড়াছড়িকে ঐতিহাসিক ‘শান্তিচুক্তি’র জনপদ আখ্যায়িত করে মো: রাশেদুল ইসলাম বলেন, পার্বত্য এলাকার সার্বিক সমৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের ‘রোল অব রেন্সপন্সেবিলিটি’ খুবই গুরুত্বপূর্ন। মিডিয়ার ইতিবাচক উপস্থাপনের ফলেই এখানকার পর্যটন বিকশিত হয়েছে দ্রুত। পর্যটন বিকাশের সাথে সাথে বেড়েছে অর্থনৈতিক গতিপ্রবাহ। তাই গণমাধ্যম এবং সাংবাদিকদের ন্যায়নিষ্ঠ পরিবেশনা ও আন্তরিক বিশ্লেষণ দেশের যে কোন অঞ্চলকেই এগিয়ে দেয়া সম্ভব।
খাগড়াছড়ির সদ্য বিদায়ী জেলা প্রশাসক মো: রাশেদুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্বাক্ষরিত ‘পার্বত্য শান্তিচুক্তি’ দেশের দক্ষিণ-পূর্বাংশের এক দশমাংশ তিন পার্বত্য জেলাকে উন্নয়ন এবং সামগ্রিক অগ্রগতিতে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। শান্তিচুক্তির ফলে এখানকার জীবনমান বিকাশে যা দৃশ্যমান হয়েছে তা নি:সন্দেহে অতুলনীয়। গত দুই দশকে অন্য দুই পার্বত্য জেলার মতো খাগড়াছড়ির প্রতিটি জনপদে সবকটি জাতিগোষ্ঠির জীবন-সংস্কৃতি ও অর্থনীতি বিকাশে নবযুগের সঞ্চার হয়েছে। এটি অসামান্য নেতৃত্বের গুণাবলীর ফসল।
প্রধানমন্ত্রীর ‘শান্তিচুক্তি’ স্বাক্ষরকে পুরো দেশের জন্য টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, সড়ক অবকাঠামো, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ, মানব সম্পদ উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশ, আবাসিক ও খাবার হোটেলের সমৃদ্ধি, বিদ্যালয়ে শিশুদের উপস্থিতি, বাল্য বিয়ে হ্রাস, নারীর ক্ষমতায়ন এবং মানুষের অর্থনেতিক অগ্রগতি সারা দেশেই স্বীকৃত হচ্ছে।
রাজবাড়ি জেলার পাংশা উপজেলা বাহাদুরপুর গ্রামে প্রয়াত মো: আমিরুল ইসলাম এবং মা নাছিম মাহফুজা খানম-এর দ্বিতীয় সন্তান মো: রাশেদুল ইসলাম লেখাপড়ায় অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন।
প্রায় দেড় বছর সময় ধরে খাগড়াছড়িতে জেলা প্রশাসক হিশেবে দায়িত্ব পালন করেছেন ১৫-তম বিসিএস ক্যাডারের এই কর্মকর্তা। ২০১৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী তিনি কর্মস্থলে যোগ দিয়েই খাগড়াছড়ি জেলার ৯টি উপজেলার মূল সমস্যা চিহ্নিত করার পাশাপাশি সম্ভাবনাগুলোকে বিকশিত করার কাজে মনযোগ দেন।
জেলা প্রশাসনকে দুর্নীতিমুক্ত রাখা, সেবা প্রাপ্তির প্রক্রিয়াকে সহজতর করা এবং সেবা গ্রহীতাদের ভোগান্তি কমাতে পুরো প্রশাসন ব্যবস্থাকে তিনি স্বচ্ছ এবং তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর করে তোলেন। জেলার পর্যটন খাতকে সুদৃঢ় করার বিষয়টি সার্বক্ষনিক তাঁর মনোজগতে বেশি স্থান পেয়েছে।
খাগড়াছড়ি জেলার সর্ব সাধারণের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য হলো, ‘এ জেলার সব শ্রেণী-পেশার মানুষের সাথেই দেখা-সাক্ষাৎ হয়েছে। কাজ করেছি দূর্গম গ্রাম থেকে ইউনিয়ন-উপজেলা এবং শহরেও। সব ক্ষেত্রেই মানুষের মূল্যবোধ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে কোন অংশে পিছিয়ে পড়া বলে মনে হয়নি। বরং এখানকার মানুষের সরলতা-সত্যবাদিতা এবং মূল্যবোধকে আমার শিক্ষনীয় মনে হয়েছে।
মো: রাশেদুল ইসলাম তিন ভাই এবং এক বোনের মধ্যে পরিবারের দ্বিতীয় সন্তান। ঢাকার উদয়ন বিদ্যালয়ে প্রাথমিক পাঠ শেষে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটি স্কুল থেকে ১৯৮৫ সালে প্রথম বিভাগে এসএসসি শেষ করেন। ১৯৮৭ সালে ঢাকা কলেজের বিজ্ঞান শাখা থেকে প্রথম বিভাগে পাশ করে ভর্তি হন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয় কলেজ (বর্তমান বিশ^বিদ্যালয়)-এ। সেখান থেকেই ১৯৯১ সালে মাস্টার্স সম্পন্ন করেন পদার্থ বিদ্যা নিয়ে।
খাগড়াছড়িতে দায়িত্ব পালনকালে নিজের অর্জনকে সহকর্মীদের সম্মিলিত সফলতা উল্লেখ করে বলেন, ইতিবাচকভাবে খাগড়াছড়িকে দেশে-বিদেশে পরিচিত করার জন্য সুউচ্চ আলুটিলা, রহস্যময় প্রাকৃতিক গুহা, তেরাংতৈবাকলাই (রিছাং ঝরনা), হাতিমাথা পাহাড়, দেবতাপুকুর এগুলো প্রাকৃতিকভাবেই সৃষ্ট। কিন্তু সেসব নিসর্গ স্থাপনায় ভ্রমণ পিপাসু মানুষের নিরিবিলি বেড়ানো, স্বস্তিতে সময় কাটানো, ব্যক্তিগত স্বাতন্ত্র্য সুরক্ষা, শৌচাগার, পর্যাপ্ত পানি ও টয়লেট, বিদ্যুৎ এবং প্রয়োজনীয় অনেক কিছুর ঘাটতি ছিল।
এখন সেসব স্পটের নাগরিক সেবার সবকটি প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছে। যেখানে সিঁড়ি দরকার, যেখানে সড়ক অবকাঠামো, যেখানে লাইটিং এবং যেখানে শৌচাগার ও টয়লেট দরকার; সেখানে সেসব নির্মাণ করা হয়েছে। একটি পরিপূর্ন বিনোদন কেন্দ্রে সাধারণত: যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকা দরকার তা নিশ্চিত করা হয়েছে। আলোকায়ন, কফি হাউস আর সুদক্ষ ব্যবস্থাপনার ফলে বলা চলে পাল্টে গেছে জেলার পর্যটন স্পটগুলো।
তিনি তাঁর সময়কালে জেলার ভাইবোনছড়ার কংচাইরী পাড়ায় ‘মায়াবিনী পর্যটন লেক’, মাটিরাঙা উপজেলা সদরে ‘জলপাহাড়’ এবং দীঘিনালা উপজেলার সদরের ‘ইয়েলো চত্বর’ নির্মাণ, ‘স্বপ্নযাত্রা রেস্টুরেন্ট’, পুস্পবৃক্ষ শোভিত সড়ক ব্যবস্থাপনা এবং সড়ক সৌর আলোকায়নকে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সৃজনশীল উদ্যোগ বলে অভিহিত করেন।
সময়ের সাথে সাথে দেশের অগ্রগতির পথে তাল মেলাতে প্রশাসনকে উন্নয়ন উদ্যোগী হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষে জোরালো যুক্তি উপস্থাপন করে তিনি বলেন, একটি জেলা বা উপজেলায় সরকারের সরাসরি ও সার্বক্ষণিক বেতন নিয়ে ডিসি আর ইউএনও-রা নিয়োজিত থাকেন। মাঠ প্রশাসনের রুটিন ওয়ার্ক করেও চাকরি জীবন অতিবাহিত করা যায়। কিন্তু মানুষ মনে রাখে কর্মকর্তাদের সততা, সেবা আর উদ্যোগকে। বিশেষ করে চিন্তাশীল উদ্যোগের মাধ্যমেই যেকোন এলাকায় নতুন কোন উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
চাকুরীর প্রথম জীবনে রাঙামাটির জেলায় কাজ করার সুবাদে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাস্তবতা সম্পর্কে তাঁর অর্জিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা বেশ সমৃদ্ধ। এ বিষয়ে তিনি বলেন, দেশের অন্য সব জেলার চেয়ে তিন পার্বত্য জেলার শাসন কাঠামো ভিন্ন হলেও তা জানা থাকলে প্রশাসন চালাতে কোন সমস্যা সৃষ্টি করে না বলেই তিনি মনে করেন।
মো: রাশেদুল ইসলাম বলেন, বৃটিশ আমল থেকে এখানকার প্রথাগত সামাজিক নেতৃত্ব, হেডম্যান-কার্বারী ব্যবস্থার ফলে বিচার-সালিশ খুবই কম। এমনকি সামাজিক বিরোধও সমতলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম।
সর্বশেষ তিনি মন্তব্য করেন, দেশের ভিন্ন শাসনকাঠামো দ্বারা পরিচালিত ও সাংস্কৃতিক বহুত্বের জনপদ হিসেবে এখানকার সামগ্রিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগানোর জন্য দীর্ঘ মেয়াদি পরিকল্পনা প্রয়োজন। এটি প্রনয়ণের ক্ষেত্রে এখানকার সব মানুষের (শ্রেণী-পেশা ও সম্প্রদায়) মতামতকে প্রাধান্য দিতে হবে। একটি গ্রহণযোগ্য পরিকল্পনা বা রোডম্যাপ সামনে থাকলে পরে এমন একটা দিন আসবে, যখন খাগড়াছড়িই হয়ে উঠবে দেশের মডেল জেলা।