তিন বিবেচনায় পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হলেন নিখিল কুমার চাকমা !
প্রকাশঃ ১৪ জুন, ২০২১ ০৭:১২:০১
| আপডেটঃ ১৮ নভেম্বর, ২০২৪ ০১:৪৬:৫৬
|
৪১৩১
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। ‘সরকারি আমলার পরিবর্তে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠির সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে চাকমা সম্প্রদায় এবং বোর্ডের প্রধান কার্যালয় রাঙামাটি হওয়ায় সেখানকার বাসিন্দা থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ’-পাহাড়ের মানুষের এই ‘তিন বিবেচনা’র দাবি উঠছে দীর্ঘদিন ধরেই। সম্প্রতি গণমাধ্যমে এনিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ হলে পাহাড়ের মানুষ ও রাজনৈতিক মহলে ব্যাপক সাড়া ফেলে। তৈরি হয় মনস্তাত্তিক চাপ।
বিষয়টি প্রধানমন্ত্রীর নজরে আসায় তিনি সংশ্লিষ্টদের মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নেওয়ার নির্দেশ দেন। নানা প্রক্রিয়া শেষে গতকাল ১৩ জুন নিখিল কুমার চাকমাকে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের নতুন চেয়ারম্যান হিসেবে তিন বছরের জন্য নিয়োগ দেন। সর্বশেষ রবিবার প্রধানমন্ত্রীর ‘অনুমোদন’ স্বাক্ষরের মধ্যদিয়ে এই তিন বিবেচনাই প্রতিফলিত হলো। দীর্ঘ দিনের জন আকাংখা পূরণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন পাহাড়ের মানুষ। প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে অর্পিত দায়িত্ব পালনে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন বলে জানিয়েছেন নব নিযুক্ত চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমাও।
নিখিল কুমার চাকমা রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের সহসভাপতি। উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয় রাঙামাটিতে হলেও রাঙামাটির বাসিন্দাদের মধ্যে এযাবৎকাল কাউকেই চেয়ারম্যান করা হয়নি। এমনকি জনগোষ্ঠির সংখ্যাগরিষ্টতার বিচারে রাঙামাটিতে চাকমা সম্প্রদায়ের আধিক্য থাকলেও একবারও চাকমা সম্প্রদায় থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়নি। এছাড়া সরকারদলের এমপি ও আমলাদের পরিবর্তে রাজনীতিকদের মধ্য থেকে নিখিল কুমার চেয়ারম্যান হওয়ায় এই তিন বিবেচনাই কার্যকর হলো।
পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরজমান জাতিগত সংঘাত নিরসনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য সরকারি সংস্থা হিসেবে ১৯৭৬ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। কিন্তু প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছরে সাড়ে বত্রিশ বছর ধরে চেয়ারম্যান পদে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার ও সরকারি আমলারাই নিয়োগ পেয়েছেন। আর তিন মেয়াদে মাত্র সাড়ে ১২ বছর বেসামরিক পর্ষদে চেয়ারম্যান ছিলেন দুই জনপ্রতিনিধি পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রী বান্দরবানের এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিং ও খাগড়াছড়ির বিএনপির সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভুঁইয়া। অথচ অনির্বাচিত যোগ্য যেকোনো ব্যক্তি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার ক্ষেত্রে আইনী কোন বাধা নেই।
গত ১৮ মার্চ তৃতীয় দফার চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ায় উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যানের পদ থেকে বিদায় নেন পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহা-পরিদর্শক নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা। পাহাড়ের এ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেতে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের দুই সহসভাপতি ও রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা ও চিংকিউ রোয়াজার নাম শোনা যায়। এছাড়া খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও খাগড়াছড়ির মহিলা এমপি বাসন্তি চাকমাও নানা মহলে তদবির করেন। আবার তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান সরকারের আমলা সুদত্ত চাকমাকেও একটি মহল চেয়ারম্যান করার চেষ্টা করেন বলে শোনা গেছে। তবে পাহাড়ি-বাঙালী জনগোষ্ঠির মাঝে নিখিল কুমার চাকমার গ্রহণযোগ্যতা সবচেয়ে বেশি থাকায় সরকার তাঁকেই নিয়োগ দিয়েছে।
পাহাড়ের আর্থ-সামাজিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রধানতম সংস্থা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’। এখানে বছরে শত কোটি টাকার বেশি উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপিসহ উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বরাদ্দ পাওয়া যায়। কিন্তু জনস্বাথের্র এ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতৃত্বই ছিল অনুপস্থিত। ফলে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে চেয়ারম্যান না করায় উন্নয়নে যেমনি জনসম্পৃক্ততা বেশি থাকছেনা তেমনি জন আকাংখাও পূরণ হচ্ছিলনা। তাই পাহাড়ের শান্তি, উন্নয়ন, স্বার্থ নিশ্চিত ও প্রতিষ্ঠানটিকে জনবান্ধব করতে হলে পাহাড়ের মানুষকেই দায়িত্বে থাকা দরকার বলে মনে করেন পাহাড়ের মানুষেরা।
স্বাধীনতাত্তোর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চাৎপদ পার্বত্য অঞ্চলের উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি স্বতন্ত্র বোর্ড গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৭৩ সালের ৯ আগস্ট তৎকালীন ভূমি প্রশাসন ও ভুমি সংস্কার মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত রাঙামাটি সার্কিট হাউজে ‘উন্নয়ন বোর্ড’ গঠনের ঘোষণা দেন। প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই ‘উন্নত সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম’ গড়তে এ অঞ্চলের অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষত: যাতায়াত, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা, কৃষি, সমাজকল্যাণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতে এবং সমন্বিত সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের উন্নয়ন ও প্রচারে কাজ করছে।
দীর্ঘকাল ধরে ‘স্থানীয় রেওয়াজ’ অনুসরণ করা হয়েছে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে। চাকমা অধ্যুষিত রাঙামাটিতে চাকমা, ত্রিপুরা অধ্যুষিত খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা, ও মারমা অধ্যুষিত বান্দরবানে মারমা সম্প্রদায় থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওা হয়েছে। এমনিক জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দল আওয়ামীলীগ এই রীতি অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু এবার সেই রীতি ভেঙে সম্প্রতি পুনর্গঠিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে মারমা সম্প্রদায় থেকে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়।
জন আকাংখা পূরণ হওয়ায় প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন পাহাড়ের মানুষ। শিক্ষাবিদ ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষের আশা আকংখার প্রতিফলন ঘটেছে এই নিয়োগে। তাই প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। সবকিছুর উর্দ্ধে থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামের উন্নয়নে নিখিল কুমার চাকমা কাজ করবেন এই প্রত্যাশা করি’।
রাঙামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি(দুপ্রক)’র সাধারণ সম্পাদক ললিত চন্দ্র চাকমা বলেন,‘এই নিয়োগে পাহাড়ের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ। জনআকাংখা তুলে ধরায় সাংবাদিকদেরকেও ধন্যবাদ জানাই। প্রত্যাশা হলো, বিতর্কের উর্দ্ধে থেকে নতুন চেয়ারম্যান যথাযথ দায়িত্ব পালন করবেন’।
নিখিল কুমার চাকমা বলেন, ‘আমাকে যোগ্য মন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানাই। পাহাড়ের মানুষের উন্নয়নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করেছেন। আমি সে উন্নয়নে সর্বোচ্চ দায়িত্ব পালন করবো’।