বৃহস্পতিবার | ০২ মে, ২০২৪
আজ বিশ্ব পানি দিবস

পাহাড়ে সেগুন বাগান পানির উৎস নষ্ট করছে

প্রকাশঃ ২২ মার্চ, ২০২৪ ০৯:৪৩:১৪ | আপডেটঃ ০২ মে, ২০২৪ ০৪:১৮:৫৩  |  ৩৪৭
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। প্রকৃতিগতভাবে তিন পার্বত্য জেলার প্রান্তিক এলাকার মানুষের ভূ-উপরিস্থ সুপেয় পানির যোগান দেয় ঝিরি-ঝর্নাগুলো। ঝিরি-ঝর্নার পানি সুপেয় পানি হিসেবে ব্যবহার করে থাকে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর মানুষ। তবে সাম্প্রতিকসময়ে দেখা গেছে পাহাড়ের ঝিরি-ঝর্না গুলোতে বছরজুড়ে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। এতে করে পাহাড়ের প্রান্তিক মানুষ সুপেয় ও ব্যবহার্য পানির সংকটেও ভুগছেন। পাহাড়ের ঝিরি-ঝর্না ও পানির উৎসগুলো নষ্ট হওয়ার পেছনে পার্বত্য চট্টগ্রামে এককভাবে সেগুন বাগান সৃজনকে দায়ী করছেন পরিবেশকর্মী ও বন কর্মকর্তারা।

পরিবেশবাদীরা বলছেন, অথনৈতিকভাবে সাবলম্বী হওয়ার আশায় পাহাড়ের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে সেগুন বাগান সৃজন করে আসছেন। এতে করে কিন্তু পরিবেশ ও জলাবায়ুর ওপর ক্রমাগত বিরূপ প্রভাব পড়ছে। পাহাড়ে বনজ বৃক্ষ বা পানি সংরক্ষণে উপযোগী বৃক্ষ সৃজন না করে সেগুনের বিস্তার বাড়ায় দিনে-দিনে শুষ্ক হয়েছে পড়েছে পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিবেশ-প্রতিবেশও। প্রাকৃতিক ঝিরি-ঝর্নাগুলোতে পানির সংকট তৈরি হওয়ায় সুপেয় পানির সংকটে ভুগছেন মানুষ। এতে করে রাঙামাটির সাজেক, জুরাছড়ির দুমদুম্যা, বরকল, বিলাইছড়িসহ বান্দরবান-খাগড়াছড়ির বিভিন্ন প্রান্তিক এলাকায় প্রতিবছরই পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়া দেখা দিচ্ছে।

পরিবেশকর্মী অর্ক চক্রবর্তী বলেন, ‘একটি ২ দশমিক ৫ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য সেগুনের চারার প্রতি ৭ দিনে ২৫০ মিলি পানি প্রয়োজন। ৫ দশমিক ৫ ইঞ্চি সেগুনের চারার ৯ দিনে ১ কাপ পানি লাগে আর একটি ১৮ ইঞ্চি সেগুনের প্রতি ২ দিনে ১ কাপ লাগে। এভাবে গাছ বড় হতে হতে তার পানির চাহিদাও জ্যামিতিকভাবে বাড়তে থাকে। এই সেগুনে গাছে কোন পাখিও বাসা বাধে না। বারবার বিভিন্ন  সভায় সেগুন বনায়ন নিষিদ্ধের কথা বলা হলেও তা শুধু বক্তব্যেই সীমিত থাকে। আঞ্চলিক দলও নিষেধাজ্ঞা দিয়ে দমাতে পারেনি। এটা একধরনের ট্রি টেরোরিজম। পানির স্তর নিচে চলে যাওয়ায় আরও ৫০-৬০ ফুট বেশি গভীরে যাওয়ায় পানিতে প্রাকৃতিকভাবেই আর্সেনিক থাকার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এই গভীর নলকূপের পানিতে আর্সেনিক থাকার কারনে বিভিন্ন রোগাক্রাহয়ে বাংলাদেশে ৭-৮ লক্ষা মানুষ প্রতিবছর মারা যেতে পারে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এসেছে।’

জানা গেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্রিটিশ শাসনামল থেকেই সেগুন বাগান সৃজন হয়ে আসছে। ব্রিটিশ শাসনামলে আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা-ডানিডার পর বন বিভাগের উদ্যোগে সেগুনের আধিপত্য বাড়ে। তবে ক্রমাগত সেগুন বাগানে পাহাড়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখে পড়ায় এই উদ্যোগ থেকে সরে এসে বন বিভাগ সেগুন বাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছে এখন। বর্তমানে পাহাড়ে বন বিভাগের সেগুন বাগানের চেয়েও ব্যক্তিমালিকানাধীন বাগানের সংখ্যা বেশি। বন বিভাগের অধীনে ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পর্যায়ে পাহাড়ে কত পরিমাণ ভূমিতে সেগুন বাগান রয়েছে এই সংক্রান্ত তথ্য কোনো দফতর ও বন কর্মকর্তাদের কাছে পাওয়া যায়নি।

রাঙামাটি শহরের প্রাচীন বাসিন্দা ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘আজ থেকে ৪-৫ দশক আগেও আমরা যখন ছাত্রী ছিলাম; তখন চট্টগ্রাম শহর থেকে ফেরার পথে কাউখালীর ঘাগড়া এলাকায় কিছু ঝর্না দেখা যেত। ঝিরিতে সারাবছরই পানি থাকত। এ সময়ে এসে ওই রাস্তায় সড়কের পাশে কোনো ঝর্না নেই। বর্ষাকাল ছাড়া ঝিরিতেও পানি থাকে না। বিপরীতে দেখা গেল সড়কের পানি তৈরি হয়েছে বিশাল-বিশাল সেগুন বাগান। এতে করে পানির উৎস নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা ছোট থাকতে বাবা যখন বাগান করেছিলেন তখন তিনি সেগুন গাছ সৃজন করেননি। পরবর্তীতে আমরা বাবার থেকেই জেনেছি সেগুন গাছের বাগানে অন্য কোনো গাছ জন্মায় না। কোনো পোকামাকড় পর্যন্ত গাছের ওপর বসে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘ব্রিটিশ আমলে ডানিডার পর বন বিভাগসহ অন্যান্যরা সেগুন বাগানকে উৎসাহিত করেছে। পরে দেখা গেল সেগুন পানি চুষে নেওয়ার কারণে মাটিতে পানি থাকে না। মাটি শুষ্ক হয়ে পড়েছে। তখন থেকেই সেগুনকে নিরুৎসাহিত করছে বন বিভাগ। কিন্তু শুধু মুখে মুখে নিরুৎসাহিত করলেই হবে না; প্রান্তিক মানুষ যারা গ্রামে থাকেন তাদের সঙ্গে এসব বিষয়ে কথা বলা দরকার। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে আলোচনা করা দরকার। মানুষ পরিবেশ বিপর্যয়ে ফেলে এখন নিজেরাই ভুগছেন।’

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ‘সেগুন কেবল পানির উৎস নষ্টের জন্যই দায়ী নয়, পাহাড়ে ভূমি ক্ষয়ের জন্য সেগুন অত্যন্ত ক্ষতিকর। তবে অথনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকায় এবং তেমন পরিচর্যা ছাড়াই কম খরচে টিকে থাকতে পারায় পাহাড়ের মানুষ সেগুন বাগানের সৃজনের দিকে ঝুঁকেছেন। এখন পাহাড়ের পরিবেশ ও প্রতিবেশ বাঁচাতে সরকারকে সেগুন সৃজনে নিরুৎসাহিত করতে হলে একটা বিশেষ প্রকল্প ও প্রণোদনা আওতার আনা দরকার। কেবল মুখে মুখে নিরুৎসাহিত করলেই হবে না। এটা আত্মবাক্য হিসেবেই থাকবে।’

ঝুম নিয়ন্ত্রণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. মো. জাহিদুর রহমান মিয়া বলেন, ‘১৮৮৯ সাল থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে সেগুন বাগান তৈরি শুরু হয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে পাহাড়ে সেগুন গাছের বাগান করায় এখন পানির উৎসগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া প্রাকৃতিক ঝিরি-ঝর্নার আশপাশের গাছপালা কেটে ফেলার কারণে মাটিতে পানি ধারণ সক্ষমতা কমছে। ঝিরি-ঝর্ণার আশপাশে বনজ গাছ থাকলে এসব গাছের শেকড় দিয়ে মাটি পানি চুষে নেয়। কিন্তু বৃক্ষ নিধনের ফলে মাটির পানির ধারণ সক্ষমতা কমায় সারা বছর পাহাড়ের পানির উৎসগুলোতে পানি পাওয়া যায় না। সেগুন পানির উৎস নষ্টের জন্য দায়ী হলেও পাহাড়ে কাঠ উৎপাদনসহ সেগুন কার্বন গ্রহনে ভূমিকা রাখে। বন বিভাগ জলবায়ু ও পরিবেশগত বিরূপ প্রভাবের কারণে সেগুন বাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছে। তবে এটি ধাপে ধাপে হবে। হঠাৎ করেই নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না।’

জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের ডিএফও এবং উপ-বন সংরক্ষক মো. রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, ‘পাহাড়ের মানুষ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার জন্য একসময়ে ব্যাপকহারে সেগুন বাগান সৃজন করেছে। এতে করে দিনে-দিনে সেগুনের বাগান বাড়ায় পাহাড়ি ঝিরি-ঝর্নাগুলোতে এখন সারাবছর পানি পাওয়া যাচ্ছে না। পানির রিসোর্সগুলো (উৎস) নষ্ট হয়ে গেছে। সব কিছু বনের অবক্ষয়ের জন্য হয়েছে। পাহাড়ে সেগুন গাছের একক বাগান সৃজন থেকে সরিয়ে আসতে হবে। এখন পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলগুলোও স্থানীয়ভাবে সেগুন বাগান সৃজনকে নিরুৎসাহিত করছেন। অনেকেই বনজ বাগান থেকে ফলজ বাগানের দিকে ঝুঁকে পড়ায় পাহাড়ে দীর্ঘমেয়াদিভাবে পানির উৎস নষ্ট হচ্ছে।’ পার্বত্য চট্টগ্রামে কি পরিমাণ সেগুন গাছের বাগান রয়েছে- এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে কি পরিমাণ সেগুন বাগান রয়েছে এটি কঠিন ব্যাপার। তবে বন বিভাগ সেগুন বাগান সৃজনে দীর্ঘদিন ধরেই নিরুৎসাহিত করে আসছে। বন বিভাগের কিছু পুরনো সেগুন বাগান থাকলেও নতুন করে সৃজন বন্ধ রয়েছে। আর পাহাড়ের মূলত ব্যক্তিগতভাবেই অধিকহারে সেগুন বাগান গড়ে উঠেছে।’

জানতে চাইলে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়ুয়া বলেন, ‘পরিবেশবিরোধী বৃক্ষ সৃজনের ফলে পাহাড়ের পানির স্তর নিচে যাচ্ছে। ঝিরি-ঝর্না শুকিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার বাড়ছে। কিন্তু আমাদের ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার কমিয়ে ভূ-উপরিস্থ পানি ব্যবহার বাড়াতে হবে। বিশেষ করে খাল-,বিল ঝিরি-ঝর্নার পানি ব্যবহার করা প্রয়োজন। পাহাড়ে পানির উৎস কমে যাওয়া নিয়ে আমাদের একটা স্টাডিও চলছে।’


রাঙামাটি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions