পার্বত্য আঞ্চলিক পরিষদ কমপ্লেক্সের লে-আউটে এসে বাধার মুখে কর্মকর্তারা
প্রকাশঃ ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ০৮:৫৩:৪৩
| আপডেটঃ ০৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ ০৩:২৪:৪২
|
৬৯৪
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। সরকারি খাস ভূমিতে বরাদ্দ পাওয়া জমি পরিদর্শনে গিয়েই স্থানীয় বাসিন্দাদের তোপের মুখে পড়েছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সদস্য ও কর্মকর্তারা। সোমবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) সকাল সাড়ে ১১টার দিকে ভেদভেদী রূপনগর এলাকায় পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কমপ্লেক্সের স্থায়ী ভবনের জন্য নির্ধারিত ভূমি পরিদর্শন ও লে-আউট করতে যান পরিষদের সদস্য, নির্বাহী কর্মকর্তারা। এসময় রূপনগর এলাকায় বসবাসরত স্থানীয় বাসিন্দাদের তোপের মুখে পড়েন তারা। পরে লে-আউট না করেই ফিরে আসতে হয়েছে পরিদর্শনে যাওয়া কর্মকর্তাদের।
জানা গেছে, আঞ্চলিক পরিষদের কর্মকর্তাদের ভূমি পরিদর্শনের খবর পেয়ে সোমবার সকাল থেকেই ওই এলাকায় অবস্থান করছিলেন আঞ্চলিক পরিষদের বরাদ্দকৃত খাস ভূমিতে বসবাস করা বাসিন্দারা। পরে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে আঞ্চলিক পরিষদের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে পৌঁছালে স্থানীয় বাসিন্দা বিক্ষোভ শুরু করেন; পরে আইনশৃঙ্খলাবাহিনী স্থানীয়দের শান্ত করেন। এসময় ঘটনাস্থলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মো. কামাল উদ্দিন, আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্না চাকমা, রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. জাহেদুল ইসলাম ও কোতোয়ালি থানার ওসি মুহাম্মদ আলী, রাঙামাটি গণপূর্তের সহকারী প্রকৌশলী জয় বড়ুয়াসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সূত্র জানায়, রাঙামাটি শহরের প্রধানকেন্দ্রে অবস্থিত আঞ্চলিক পরিষদের অস্থায়ী ভবনটি স্থানান্তরের লক্ষ্যে ২০১৯ সালে জেলা শহরের উপকন্ঠ ভেদভেদী রূপনগর (পুরাতন রেডিওস্টেশন) এলাকায় আঞ্চলিক পরিষদ কমপ্লেক্সের জন্য ১৪ দশমিক ৭৫ একর ভূমি নামজারি করা হয়। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) এক বৈঠকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ কমপ্লেক্স নির্মাণ প্রকল্পটি পাস হয়। ২০২০ সালে ছয়তলা ভিতবিশিষ্ট চারতলা ভবন নির্মাণের জন্য তিন বছর মেয়াদি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। তবে নির্ধারিত সময়েও প্রকল্পের কাজ শুরু করতে না পারায় আরো দুই বছর সময় বর্ধিত করা হয়েছিল। বর্ধিত সময় অনুযায়ী প্রকল্পটির মেয়াদকাল শেষ হচ্ছে চলতি বছরের জুনেই। প্রকল্পটির প্রাক্কলিক ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৭ কোটি টাকা, বাস্তবায়ন করবে রাঙামাটি গণপূর্ত বিভাগ। তবে ভূমিসহ নানা জটিলতায় প্রকল্পটি শুরু করতে না পারলেও মেয়াদ শেষের চার মাস আগে লে-আউট করতে গিয়েই স্থানীয়দের তোপের মুখে পড়েছে আঞ্চলিক পরিষদ।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা ২০০১ সাল থেকে রূপনগর এলাকায় স্থায়ীভাবে বসবাস করে আসছেন। তবে ওই সরকারি খাস জমি আঞ্চলিক পরিষদের স্থায়ী ভবনের জন্য বরাদ্দ করায় বর্তমানে তারা উচ্ছেদ আতঙ্কে আছেন। ভূমিহীন মানুষেরা ঠাঁই নেওয়ার জন্য এই এলাকায় বসতি গড়ে তুলেছেন। তাদের অনেকেই বলছেন ওই খাস জমিতে তারা কিনে নিয়ে ঘরবাড়ি বেঁধে বসবাস শুরু করেন। তবে অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সময়ে স্থানীয় রাজনৈতিক দলের নেতারা এসব সরকারি খাস জমি বেদখল করে বসবাস করে আসা স্থানীয়দের কাছে বিক্রি করেছেন। বর্তমানে স্থানীয়রা ভোগ দখলীয় ভূমি হিসেবে বসবাস করে আসছে।
স্থানীয় বাসিন্দা জোহরা বেগম বলেন, ‘আমাদের নিজস্ব কোনো জায়গা-সম্পত্তি নেই। আমরা অনেক বছর ধরে এখানে বসবাস করে আসছি। বাহিরের দেশ থেকে যদি রোহিঙ্গা এসে আশ্রয় নিতে পারে, তবে আমরা দেশের মানুষ হয়েও কেন পারব না। আমরা এখানকার স্থানীয় মানুষ, এখানে বাস করতে চাই, আমাদের পুনর্বাসন চাই।’
চম্পা আক্তার নামে আরেকজন বলেন, ‘আমাদের আন্দোলন অধিকারের জন্য। এখানে ২০০২ সাল থেকে বসবাস করছি। এখানে তখন কোনো খালী জায়গা ছিল না, জঙ্গল ছিল। আমরা জঙ্গল পরিষ্কার বসবাস শুরু করেছি। যারা বসবাস করছেন অনেকেই দিনমজুর। আমরা এখানে জায়গা কিনে বসবাস করে আসছি। কিছু দিন পরপর আমাদেরকে হুমকি-ভয়ভীতি দেখায়। আমাদের বলা হচ্ছে এখান থেকে ওঠে যেতে। আমরা কেন ওঠে যাব, এই জায়গা তো কিনেছি। এখানে যারা থাকে তারা একদিন কাজে না গেলে ঘরে খাবার জুটে না। সরকারের কাছে আমাদের অনুরোধ, আমরা এখানেই থাকতে চাই। এখান থেকে উচ্ছেদ করলে আমাদের জায়গার কোনো জায়গা নেই।’
রূপনগর সমাজ উন্নয়ন কমিটির সভাপতি আবু বক্কর লিটন বলেন, ‘আজকে (সোমবার) আমাদের বলা হয়েছে জেলা প্রশাসক বরাবর একটি লিখিত আবেদন দিতে, আমরা আবেদন করব। পরবর্তীতে আমাদের সঙ্গে আলোচনার জন্য বসা হবে। আমরা এখানে দুই যুগের বেশি সময় ধরে বসবাস করছি। কিন্তু কখনো কোনো সংস্থা কিংবা কেউ এখানে আসিনি। আমাদের দাবি এখান থেকে উচ্ছেদ করা হলেও যেন ভূমি ব্যবস্থা করা হয় এবং ঘরবাড়ি ফেরত চাই।’
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের নির্বাহী কর্মকর্তা সুবর্না চাকমা জানান, ‘আজকে আমাদের এখানে আঞ্চলিক পরিষদের মূল ভবনের জন্য লে-আউট দেওয়ার কথা ছিল, কিন্তু দিতি পারিনি। আমরা এসে দেখি যে এখানে অনেক লোকজন। তাদের কিছু বক্তব্য আছে, আমরা তাদের বক্তব্য শুনলাম ও আশপাশের এলাকা দেখলাম। তাদের বক্তব্য শুনে যেটা বুঝলাম আমাদের বসা দরকার। তারা জেলা প্রশাসক বরাবরে আবেদন করবেন; পরে আমরা একটি বৈঠকে বসব যেন সবাই মিলে শান্তিপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নিতে পারি। এটা একটি সরকারি প্রজেক্ট। আমরা যেন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে কাজ করতে পারি, সেজন্য সবার সহযোগিতা লাগবে।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ সদস্য ও জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা হাজী মো. কামাল উদ্দিন বলেন, ‘এই দাবিগুলো যে আমরা সুরাহা করতে পারব; তেমনটা নয়। এটা প্রশাসনিক বিষয়।’
ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা রাঙামাটির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) মো. জাহেদুল ইসলাম বলেন, ‘এই ভূমিটি আঞ্চলিক পরিষদের অফিস কমপ্লেক্সের জন্য নির্ধারিত জায়গা। স্যাররা আজকে লে-আউট করার জন্য এসেছেন। এখানে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন লোকজন বসবাস করে আসছে। আমরা আইনশৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য হিসেবে এখানে এসেছি। স্যাররা এখানে যারা বসবাস করছেন তাদের বক্তব্য শুনছেন এবং নীতিমালার আলোকে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা হবে জানিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলাবাহিনী হিসেবে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করব।’