সাকিব আলম মামুন, সিএইচটি টুডে ডট কম, লংগদু (রাঙামাটি)। দেশে সুযোগসন্ধানী মানুষের অভাব নেই। তারা কখনো বনের জমি, কখনো সরকারি সংস্থার জমি, কখনো খাসজমি দখল করে নেয়। এদের হাত থেকে রক্ষা পায় না খালবিল, নদীনালার জমিও। সম্প্রতি পার্বত্য জেলা রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় প্রায় অর্ধশত একর বন বিভাগের জমি প্রভাবশালীদের অবৈধ দখলে রয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
তবে এরমধ্যে কোথাও কোথাও করাতকল, বাজার ও বাড়িঘর তুলে দিব্যি বসবাস করছে। বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অবহেলা, উদাসীনতা এবং অনৈতিক সুবিধা নিয়ে জবর দখলকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেওয়ারও অনেক অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া বনের গাছ চুরি অব্যাহত থাকায় পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্য পড়েছে হুমকির মুখে। বনে গামারী, সেগুন সহ অন্যান্য ফলজ ও ভেজষ উদ্ভিদ না থাকায় একদিকে যেমন দেখা দিয়েছে বন্যপ্রাণীদের খাদ্য সঙ্কট, অন্যদিকে ঐতিহ্য হারাচ্ছে লংগদুর পাহাড়ি-প্রাকৃতিক বনাঞ্চল।
এছাড়াও বন কর্মকর্তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে উপজেলার সংঘবদ্ধ গাছ চোররা প্রতিনিয়ত বন থেকে গাছ চুরি করছে। ফলে বঞ্চিত হচ্ছে সামাজিক বনায়নের অংশিদাররা। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ টাকার রাজস্ব আয় থেকে।
অনুসন্ধান এবং বনবিভাগের বনভুমি জবরদখল সংক্রান্ত তথ্য ঘেটে জানা গেছে, সংরক্ষিত বনের লংগদু উপজেলার আটারকছড়া ইউনিয়নের আলুটিলা এলাকায় প্রভাবশালী আওয়ামী যুবলীগ নেতা খলিল জমাদ্দার ও তার বাবা সহ তিন ভাইয়ের নামে চট্টগ্রাম উত্তর বন বিভাগের উল্টাছড়ি রেঞ্জের ২৭ নম্বর মৌজার প্রায় অর্ধশত একর জমি জবরদখল করে রেখেছেন।
সরেজমিন ঘুরে বনবিভাগ ও স্থানীয় লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, আটারকছড়ার রফিজ উদ্দিন জমাদ্দারের ছেলে নুরু মিয়া জমাদ্দারের নামে এক ব্যক্তি বন বিভাগের জমি কার্টিজ মুলে ক্রয় করে জমি দখল করেছেন। শুধু তিনি একাই নন, তার ছেলে জসিম জমাদ্দার, খলিল জমাদ্দার ও জলিল জমাদ্দার প্রভাব খাটিয়ে বন বিভাগের জমি এভাবে দখল করে নিচ্ছে। কর্তৃপক্ষের নজরদারির অভাবে স্থানীয় প্রভাবশালীরা বসতি নির্মাণ করে বনের জমিকে নিজের বলে দাবি করে থাকে। বন বিভাগের জায়গা দখল করে ভুয়া দলিল ও কাগজপত্র তৈরি করে অন্যের কাছে বিক্রি করে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। আবার দখলদাররা আইনি ঝামেলা এড়াতে কৌশলে জমি খোলা স্ট্যাম্পে বিক্রি করে দেন। তাদের উচ্ছেদ অভিযানও করতে পারেনি বনবিভাগ।
তবে দখলদার নুরু মিয়া জমাদ্দার ও তার ছেলে খলিল জমাদ্দার দাবি করে বলেন, সংরক্ষিত বনের বাইরে ৪ ও ৬ ধারার জমি সিএস পর্চামূলে তারাই মালিক। এসএ ও আরএসে মালিক বনবিভাগ। তাদের এসব জমির সকল কাগজপত্র রয়েছে। বন বিভাগের কোনো জমি তাদের অবৈধ দখলে নেই বলেও জানান। আইনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সকল জমি ক্রয় করা হয়েছে এবং বলা হচ্ছে ৫০ একরের বেশি জমি। আসলে এখানে এতো জমি নেই।
স্থানীয় ভুক্তভোগী মো. সাখাওয়াত হোসেন, মো. জয়নাল আবেদীন, নুরু মিয়া পিসি, খাদিজা বেগম ও এলাচি বেগম বলেন, ওই জমি তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি না। ১৯৯৪ সালে বন বিভাগ এখানে বাগান করেছে এবং এই বাগানে আমরা কাজও করেছি। ২০১০ সালে এসে শুনি এসব জায়গা সব নুরু মিয়া জমাদ্দার ও তার তিন ছেলের নামে। তৎকালীন বন বিভাগের কর্মকর্তাদের আর্থিক সুবিধা দিয়ে এবং দলীয় প্রভাব বিস্তার করে জালিয়াতি কাগজপত্র করে সরকারি এ বনভূমি তারা দখলে নিয়েছে। তবে এর আশপাশের কিছু জমি বনবিভাগ সামাজিক বনায়ন করেছে। সব জমি সামাজিক বনায়ন করলে তাদের কোন আপত্তি থাকবে না।
তারা আরও বলেন, বন বিভাগের এ জমি সংক্রান্ত বিষয়ে তাদের সাথে কথা বলতে গেলেই হামলা মামলা দিয়ে আমাদের হেনস্তা করছে কয়েকবার। আমরা এর সুষ্ঠু নিরপেক্ষ ও তদন্ত সাপেক্ষে সঠিক বিচারের দাবি জানাই।
এ বিষয়ে ২৭ নম্বর আটারকছড়া মৌজা হেডম্যান আখি চাকমা জানান, এক সময় এই জমি গুলো পাহাড়িদের বন্দোবস্ত ছিল। বন বিভাগ না জেনে এখানে বাগান করে, পরবর্তীতে স্থানীয়রা বন বিভাগের করা বাগান ভোগ করে। এক সময় হয়তো পাহাড়িদের কাছ থেকেই তারা এ জমি কিনে নিছে। তবে তিনি জমি সংক্রান্ত সুস্পষ্ট কোনো তথ্য দিতে পারেনি এ প্রতিবেদককে।
স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান অজয় চাকমা মিত্র বলেন, এটা অনেক পুরনো অভিযোগ। আমি যতদূর জানি দখলকৃত ৫০ একর জমির পাশে ৪-৫ একর জমি তারা কিনে নিয়েছিলেন। পরবর্তীতে পুরো জমি দখলে নিয়ে নেয়। সেখানে যে বসতি ছিল সেগুলোও তারা উচ্ছেদ করে দেয় বিভিন্নভাবে। তবে এসবের একটা চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেয়া এখন সময়ের দাবি।
উল্টাছড়ি বন বিভাগের বন কর্মকর্তা এসএম মাহবুব উল আলম জানান, আমি দায়িত্বে আসার পরে এমন কিছু হয় নাই। আগে কোন কর্নকর্তা কি করেছে সে বিষয়ে আমার জান নাই। তবে অভিযোগের ভিত্তিতে দখলকৃত জমি পরিদর্শন করা হবে। আমাদের বন বিভাগের জমি হলে আইনী প্রক্রিয়ার এর ব্যবস্থা নেয়া হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জবরদখল মুক্ত করতে কর্মকর্তাদের সদিচ্ছার অভাব নেই। ইতোমধ্যে বনের জবরদখলকৃত জমির তালিকা মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে। সরকারে সিদ্ধান্ত মোতাবেক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
উদ্বেগ প্রকাশ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কফিল উদ্দিন মাহমুদ বলেন, অবৈধভাবে বনের জমি এভাবে দখল থাকতে পারে না। দখলকারী যতবড় প্রভাবশালী লোকই হোক না কেন তাদের উচ্ছেদ করে বনের জীব বৈচিত্র্য ও পরিবেশ রক্ষা করা হবে। ইতোমধ্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রনালয় থেকে জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেখানে অবৈধ দখলে থাকা বনভুমি উদ্ধারে একটি কর্মপরিকল্পনা তৈরী এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাজার ও ব্যক্তি পর্যায়ে জমি উদ্ধারে অগ্রাধিকার দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আটারকছড়া ইউনিয়নে বনবিভাগের জায়গা দখলের বিষয়টি নজরে এসেছে। আমরা একটি লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। এরই মধ্যে তদন্ত টিম গঠন করেছি। শীঘ্রই আমরা জমি উদ্ধারের ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
প্রসঙ্গত, ভূমি বিরোধের কারণে ১৯৮৫ সাল থেকে তিন পার্বত্য জেলার রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে ভূমি বন্দোবস্তি বন্ধ করে দেয় সরকার। তবে অসাধু চক্রের রোষানলে চলছে ভুয়া কাগজপত্রের ছড়াছড়ি। এরমধ্যে ২০১০ সালের পর থেকেই রাঙ্গামাটিতে এই প্রবণতা বেড়েই চলছে। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভুয়া বন্দোবস্তি লংগদু উপজেলার আঠারকছড়া মৌজায়। বন বিভাগের তথ্য মতে আটারকছড়া এলাকায় রিজার্ভের ৫০ একরের অধিক জমি স্থানীয় প্রভাবশালী চক্রের অবৈধ দখলে।