আজ পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন আদিবাসী ছাত্র, যুব ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নাগরিক কমিটির পক্ষে দেয়া এক বিবৃতিতে বলা হয়, পার্বত্য চট্টগ্রামের সচেতন ছাত্র, যুব ও নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাথে আমরা সংহতি প্রকাশ করছি। সমগ্র বাংলাদেশে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আত্মবলিদানকারী সকল শহীদকে আমরা বিনম্রচিত্তে শ্রদ্ধা ও স্মরণ করছি। ছাত্র-জনতার গণঅভ্যূত্থানের পরে পরবর্তী পরিস্থিতিতে দায়িত্ব নেওয়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অভিনন্দন জানাই। সেই সাথে আদিবাসী ছাত্র, যুব ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সাথে সংলাপ আয়োজন এবং তাঁদের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়ার জন্য নব গঠিত অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ও বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রতিনিধিবৃন্দের প্রতি আমরা উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি।
একইভাবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সাধারণ পাহাড়ি ছাত্র-যুবকদের গ্রাফিটি অংকনসহ অন্যান্য বিক্ষোভ ও শান্তিপূর্ণ কার্যক্রমের প্রতি আমাদের সমর্থন জানাচ্ছি।
পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশের সমতল অঞ্চলের পাহাড়ীরা
যুগ যুগ ধরে অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থার শিকার হয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর থেকে
বর্তমান সময় পর্যন্ত কোনো সরকারই স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ের নীতিনির্ধারণী
পদে পাহাড়ীদের প্রতিনিধিত্বশীল ব্যক্তিবর্গকে যথাযথভাবে অর্ন্তভুক্ত করেনি। রাষ্ট্রীয়
ব্যবস্থায় আদিবাসীদের স্বকীয় পরিচিতি ও অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি বলে স্বশাসনের
দাবীতে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র সংগ্রাম হয়েছিলো। এ সমস্যাকে রাজনৈতিকভাবে সমাধানের
উপায় হিসেবে তৎকালীন সরকার ১৯৯৭ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এ
পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির অন্যতম মৌলিক চেতনা ছিল রাষ্ট্র পরিচালনায় পাহাড়ি আদিবাসীসহ
সকল সম্প্রদায়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এ এলাকায় টেকসই শান্তি প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়ন ত্বরান্বিত
করা।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, যে উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে পার্বত্য
চট্টগ্রাম চুক্তি সম্পাদন করা হয়েছিলো, ঠিক সেভাবে এ চুক্তি বাস্তবায়ন করা হয়নি। পার্বত্য
অঞ্চলে সুশাসন ও উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন
পার্বত্য জেলা পরিষদ গঠন করা হলেও সেগুলোকে ক্ষমতায়ন করা হয়নি। আইন অনুযায়ী এ অঞ্চলের
স্থায়ী অধিবাসীদের প্রত্যক্ষ ভোটে এ পরিষদগুলো এখনো গঠন করা হয়নি। এ প্রতিষ্ঠানগুলো
এ যাবত ক্ষমতাসীন দলগুলোর নত-র্কমীদের পুনর্বাসন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে।
ফলে পার্বত্য অঞ্চলের জনগণ তাদের পছন্দের লোককে স্থানীয় শাসন তথা রাষ্ট্র পরিচালনার
কাজে নির্বাচিত করার সুযোগ পায়নি। ক্ষমতার অপব্যবহার, সর্বব্যাপী দুর্নীতি ও দলীয়করণের
কারণে পাহাড়ের জনগণ কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন থেকে বঞ্চিত হয়েছে। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম
চুক্তি বাস্তবায়নকে বাধাগ্রস্ত করাসহ পাহাড়ি আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার খর্ব করার বিভিন্ন
পাঁয়তারা চালু রয়েছে।
এমতাবস্থায়, উল্লেখিত বিষয়গুলো বিবেচেনায় রেখে আমরা পার্বত্য চট্টগ্রামের নাগরিক সমাজ, প্রথাগত প্রতিষ্ঠান ও ছাত্র-যুব সমাজের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে আবেদন জানাই, এ সরকার যেন পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি বাস্তবায়নসহ সাংবিধানিকভাবে এবং অন্যান্য আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে আদিবাসীদের অধিকার সুরক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করে। এ লক্ষ্যে আমরা নিম্নোক্ত দাবিগুলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে উত্থাপন করছিঃ
১. যত দ্রুত সম্ভব অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় ও অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাদের সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সমতলের সচতেন আদিবাসী ছাত্র, যুব ও নাগরিক সমাজের সাথে সাক্ষাৎ ও আলোচনা করার ব্যবস্থা করা।
২. সচেতন আদিবাসী ছাত্র, যুব ও নাগরিক সমাজের সাথে যথাযথ আলোচনা ও সম্মতি সাপেক্ষে নিমোক্ত বিষয়গুলোর ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা:
(ক) পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড-এর চেয়ারম্যান নিয়োগ করা;
(খ) ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরনার্থী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুর্নবাসন বিষয়ক টাস্কর্ফোস-এর চেয়ারম্যান নিয়োগ করা;
(গ) অন্তর্বর্তীকালীন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ করা;
৩. নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব না নেওয়া পর্যন্ত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০’ সম্পর্কিত সিভিল রিভিউ পিটিশন নম্বর ৫৪/২০১৮ এবং ১৯২/২০১৮ এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি ১৯৯৭, পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ আইন, ১৯৯৮ এবং পার্বত্য জেলা পরিষদ (সংশোধনী) আইন, ১৯৯৮ সম্পর্কিত সিভিল আপীল নম্বর ৯৫/২০১১-মামলাসমূহের শুনানি স্থগিত রাখার জন্য এটর্নি জেনারেলকে যথাযথ নির্দেশনা প্রদান করা।
৪. বিধি প্রণয়নসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ সাপেক্ষে পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমিবিরোধ নিষ্পত্তি কমিশনকে কার্যকর করা;
৫. কার্যপরিধি পরিবর্তনের মাধ্যমে ‘ভারত প্রত্যাগত উপজাতীয় শরর্ণাথী ও অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কর্ফোস’ কর্তৃক স্বীকৃত ও অস্বীকৃত ভারত প্রত্যাগত জুম্ম শরর্ণাথী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের অন্তর্বর্তীকালীন ও চূড়ান্ত পুনর্বাসন নিশ্চিত করা;
৬. সরকারি চাকুরীতে ৫ শতাংশ আদিবাসী কোটা ও আদিবাসী শিশুদের জন্য স্ব স্ব মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ নিশ্চিত করা।
৭. আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন বা নীতির আলোকে সাংবিধানিকভাবে দেশের আদিবাসীদের পরিচয় ও তাঁদের অধিকারের স্বীকৃতি প্রদান করা এবং অন্যান্য আইনি ও প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা;
৮. বৈষম্যহীন ও মৌলিক অধিকার সম্বলিত একটি গণতান্ত্রিক পরিবেশ সৃষ্টি করা, যেখানে দেশের সকল আদিবাসীসহ অন্যান্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, শিশু ও নারীরা নিরাপদে বসবাসের অধিকার লাভ করতে পারেন।