দখল-দূষণে বিবর্ণ কাপ্তাই হ্রদ , ক্রমাগত ছোট হয়ে আসছে
প্রকাশঃ ০১ জুন, ২০২৪ ০৪:৪১:২১
| আপডেটঃ ২৬ নভেম্বর, ২০২৪ ০৩:৩৭:২৭
|
৫০৫
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। ষাটের দশকে কর্ণফুলী নদীর কাপ্তাই অংশে বাঁধ দেওয়ার ফলে প্রায় ৫৪ হাজার একর কৃষি জমি পানিতে তলিয়ে সৃষ্টি হয় কৃত্রিম কাপ্তাই হ্রদ। কৃষি জমি ছাড়াও পানিতে তলিয়ে গেছে অসংখ্য মানুষের ঘরবাড়ি ও বিস্তীর্ণ পাহাড়। উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহত্তম কৃত্রিম এই জলাধারের আয়তন ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর। তবে অনেকটা কাগুজে-কলমে এই আয়তনের কথা বলা হলেও কাপ্তাই হ্রদের আয়তন গভীরতা নিয়ে কোনো জরিপ করা হয়নি বিগত ছয় দশকেও। তবে দিন-দিন ক্রমাগত হ্রদ বেদখল হয়ে পড়ার ফলে ছোট হয়ে আসছে কাপ্তাই হ্রদের আয়তন। কাপ্তাই হ্রদ কেন্দ্র করে গড়ে উঠা হাঁট-বাজার ও জনবসতিপূর্ণ এলাকার ময়লা-আবর্জনা, পয়ঃব্যবস্থাপনার গাফিলতির কারণে বাড়ছে দূষণও। সব কিছু মিলিয়ে ধীরে ধীরে দখলে-দূষণে আরও বিবর্ণ হচ্ছে স্বচ্ছ নীল জলারাশির হ্রদটি।
অবশ্য দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি ও উন্নয়নকর্মী মো. ওমর ফারুক বলেছেন, ‘বিগত ছয় দশকে কাপ্তাই হ্রদের দখল-দূষণ তো অনেক হয়েছে। এবার এর লাগাম টেনে ধরা দরকার। বিশেষত শুষ্ক মৌসুমে যখন কাপ্তাই হ্রদের পানি কমে গিয়ে হ্রদের উঁচু এলাকা ভেসে উঠে সেখানে বেদখল শুরু হয়। এবারও প্রতিবছরের মতো জেলার বিভিন্ন এলাকায় হ্রদ ভরাট ও বেদখল করা হচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদ পরিচালনায় হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটিও রয়েছে। হ্রদে দখল-ভরাট বন্ধে হ্রদ ব্যবস্থাপনা কমিটি ও প্রশাসনকে একযোগে কাজ করতে হবে। হ্রদ রক্ষায় প্রশাসন যদি নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে তাহলে তো আমরা অসহায় হয়ে যাব।’
রাঙামাটি জেলা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সরেজমিন পরিদর্শন করে দেখা যাচ্ছে, চারদিকে চলছে হ্রদ বেদখলের মহোৎসব। জেলা শহরের রিজার্ভবাজার, তবলছড়ি, দক্ষিণ কালিন্দীপুর-হাসপাতাল এলাকা, তবলছড়ির আর্ট কাউন্সিল কলোনীসহ সবদিকেই চলছে দখলের মহোৎসব। থেমে নেই উপজেলাগুলোতেও, সেখানেও একই চিত্র। শুষ্ক মৌসুমে হ্রদ দখল ও ভরাটে সক্রিয় হয়ে উঠে ভূমি দস্যুরা। বিগত চার মাস যাবৎ রাঙামাটির লংগদু উপজেলায় মাইনীমুখে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে নদী খননের বালি দিয়ে কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের অভিযোগ ওঠে। পরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সংবাদ প্রচারেরর পর প্রশাসনের টনক নড়ে এবং সেই হ্রদ ভরাটের কাজ বন্ধও করে দেয় প্রশাসন। ঘটনার তদন্ত করে জড়িতদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পুলিশকেও নির্দেশ দিয়েছেন আদালত।
এছাড়া ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবর হাইকোর্ট এক রিট পিটিশনের ভিত্তিতে রাঙামাটির কাপ্তাই হ্রদে অবৈধ দখল, ভরাট ও স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে স্থানীয় প্রশাসনকে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দিয়েছেন। ওই রিট পিটিশনে পরিবেশ ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব, পরিবেশ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, রাঙামাটির জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের বিবাদী করা হয়েছে। আদালতের রিট পিটিশন নম্বর ১১৮৮৫/২০২২। কাপ্তাই হ্রদ ভরাট ও দখল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও তা অমান্য করে বেদখল চলছে। পরিবেশবাদীরা এর জন্য স্থানীয় প্রশাসনের বিরুদ্ধে নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ তুলছেন।
সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন রাঙামাটি জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক এম জিসান বখতেয়ার বলেন, ‘শুষ্ক মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদ দখলে চারদিকে মহোৎসব শুরু হয়। কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনায় একটি কমিটিও রয়েছে। কিন্তু হ্রদ ব্যবস্থাপনার কমিটির বৈঠক করা ব্যতিত হ্রদ রক্ষায় কোনো কর্মসূচি আমরা দেখতে পাচ্ছি না। জেলা প্রশাসনকে কাপ্তাই হ্রদ রক্ষায় সবচেয়ে বেশি ভূমি রাখতে হবে। এছাড়া যারা সচেতন মানুষ-জনপ্রতিনিধি আছেন তাদেরও দায় রয়েছে। বিশেষত করে দেখা যাচ্ছে হ্রদ বেদখলের পেছনে সরকারি প্রতিষ্ঠান, রাজনৈতিক নেতা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধি-প্রভাবশালীরাও জড়িত। প্রত্যেক বছর শুষ্ক মৌসুমে এমন দখল চলে আসলেও প্রশাসন কেন জানি নির্লিপ্ত। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত থাকায় সাধারণ মানুষও হ্রদ দখলে উৎসাহ পাচ্ছে। হ্রদে দখল বন্ধে হাইকোর্টের নির্দেশনা থাকলেও সেটি অমান্য করা হচ্ছে।’
কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটির একটা বড় সম্পদ উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়–য়া বলেন, ‘ক্রমাগত হ্রদের পানির দূষণ বাড়ার ফলে মৎস্য সম্পদ ও ব্যবহার্য পানির ক্ষেত্রেও বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষত কাপ্তাই হ্রদে সেসব লঞ্চ-বোট চলাচল করে। হ্রদ এলাকার পাশর্^বর্তী ঘরবাড়ি ও ঘনবসতি এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো নয়। সেফটি ট্যাংকির ময়লা যাচ্ছে সরাসরি কাপ্তাই হ্রদে; এসব কারণে হ্রদের পানির মান কমছে। তারমধ্যে গাছের এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অন্যতম বিরূপ প্রভাব ফেলছে।’
কাপ্তাই হ্রদ বেদখল ঠেকাতে প্রশাসনের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটির জেলাপ্রশাসক ও কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘রাঙামাটির কোথাও কাপ্তাই হ্রদ দখল করা হচ্ছে এমন ঘটনা থাকলে আমাদের জানান। আমরা আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করব।’