শুক্রবার | ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪

কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে অর্ধশতাধিক করাতকল, বাড়ছে দূষণ-ভরাট

প্রকাশঃ ৩১ মে, ২০২৪ ০৮:৪৭:৩৭ | আপডেটঃ ২০ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০৫:০৬:১৫  |  ৪৬৫
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পার্বত্য জেলা রাঙামাটির অর্থনীতির অন্যতম দিক হচ্ছে কাঠ-গাছের ব্যবসা। পার্বত্য চট্টগ্রামের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ-কাঠের কদর রয়েছে। সে কারণে পাহাড়ি কাঠের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে। পাহাড়ে উৎপাদিত এসব গাছের বাকল ফেলার পর ড্রেসিং বা গাছের গুঁড়ির উপরি অংশে মসৃণ করে বাজারজাতকরণ করা হয়ে থাকে। এরপর এসব গাছের কাঠ গুঁড়ি কিংবা টিম্বার হিসেবেই পরিবহন করা হয়। কিন্তু গাছের অংশ বিশেষ ছাঁটাই করে মসৃণ করার ফলে যেসব ড্রাই বা বর্জ্য তৈরি হয় সেগুলো ফেলে রাখা হচ্ছে করাতকলের পাশেই। কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে এসব করাত বা চিরাইকল গড়ে উঠার ফলে গাছের বাকল ও ড্রেসিং করা গাছের অংশ ফেলছে কাপ্তাই হ্রদে। দীর্ঘসময় ধরে এভাবে চলে আসছে। ফলে একদিকে কাপ্তাই হ্রদ ভরাট হচ্ছে; আরেকদিকে গাছের বাকল-গাছ ছাঁটাইয়ের অংশ বিশেষ পানিতে মিশে দূষণ বাড়াছে হ্রদে পানির।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, প্রায় এক দশক আগেও রান্নার চুলার কাজে এসব কাঠ জ¦ালানি হিসাবে ব্যবহার করা হলেও বর্তমান সময়ে এসে রান্নার কাজে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহারের ফলে ছাঁটাই করা কাঠের ব্যবহার কমে আসছে। বর্জ্য জাতীয় গাছ ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্টদের কোনো নির্দেশনা না থাকায় যত্রতত্রভাবে ফেলা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদে। হ্রদ ভরাট ও হ্রদের পানির দূষণ বাড়লেও এ ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ দেখা যায়নি। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, পাহাড়ের অর্থনীতিকে চাঙা রেখেছে গাছ ও পর্যটনশিল্প। গাছ ব্যবসাকেন্দ্রিক এসব করাতকল গড়ে উঠলেও বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কোনো উদ্যোগ নেই। গাছের বর্জ্য ও কষ (রস) পানিতে মিশে হ্রদের পানির দূষণ করছে। হ্রদে পানি বাড়লে করাতকলের আশপাশের হ্রদের পানি কালচে রঙ ধারণ করে থাকে। এটা হ্রদের মাছের জন্য ঝুঁকি রয়েছে। এ ব্যাপারে বন বিভাগ ও প্রশাসনের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।

রাঙামাটি জেলাজুড়ে কয়টি করাতকল রয়েছে; সেটির সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে পুরো জেলায় এক থেকে দেড় শতাধিক করাতকল রয়েছে; এরমধ্যে অর্ধশতাধিক কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে। বিশেষত রাঙামাটির নানিয়ারচর, সদর, লংগদু, বাঘাইছড়ি, জুরাছড়ি, বিলাইছড়ি, বরকল, কাপ্তাই উপজেলার করাতকলগুলো হ্রদ ঘেঁষে। রাঙামাটি জেলা শহরের রিজার্ভবাজারে চারটি, তবলছড়িতে পাঁচটি, বনরূপা এলাকায় সাতটিসহ আসামবস্তি ছাড়াও জেলা শহরের মধ্যেই ২০-২২টি করাতকল রয়েছে; সেগুলোর সবই কাপ্তাই হ্রদের পাশেই। করাতকল গুলোর দূষিত বর্জ্য প্রভাব ফেলছে সরাসরি কাপ্তাই হ্রদে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন করাতকল মালিক জানিয়েছেন, বন বিভাগ ও প্রশাসনের অনুমতি নিয়েই তারা করাত বা চিরাইকল স্থাপন করে গাছ চিরাই করে কাঠ তৈরি করে আসছেন। কিন্তু গাছ চিরাইয়ের অংশ ফেলা বা ব্যবস্থাপনা নিয়ে কোনো কর্তৃপক্ষের নির্দেশনার বিষয়টি তাদেরও জানা নেই। আগে রান্নার কাজে জ¦ালানি হিসেবে চিরাই গাছের বর্জ্য ব্যবহৃত হলেও এখন কমে গেছে। যে কারণে গাছের বর্জ্য করাতকলের আশপাশের অংশেই ফেলা হচ্ছে। গাছ পরিবহনের সুবির্ধাতে কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে এসব করাতকল গড়ে ওঠার ফলে বর্জ্য কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষে ফেলা হচ্ছে। এতে করে হ্রদের কিছু অংশ ভরাট ও পানির দূষণও হচ্ছে।

দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি (দুপ্রক) রাঙামাটি জেলা কমিটির সভাপতি মো. ওমর ফারুক বলেন, ‘পরিবহন ও বাজার ব্যবস্থাপনার সুবিধার্তে স’মিল বা করাতকলগুলো কাপ্তাই হ্রদ ঘেঁষেই করা হয়ে থাকে। কাপ্তাই হ্রদের পানি ভরপুর থাকা সময়ে নৌ-পথে ইঞ্জিনচালিত নৌকা বা বোট দিয়ে এসব গাছ মিলে আনা হয়। গাছের ব্যবসা রাঙামাটির গুরুত্বপূর্ণ একটি অর্থনৈতিক দিক। তবে দীর্ঘদিন ধরে করাতকলের ড্রাই বা বর্জ্যগুলো ফেলা হচ্ছে কাপ্তাই হ্রদের মধ্যে। এতে করে কাপ্তাই হ্রদ ভরাটের পাশাশাশি হ্রদের পানির দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। গাছের কষ পানিতে দূষিত করে আসছে। এ ব্যাপারে প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।’

জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর রাঙামাটির নির্বাহী প্রকৌশলী পরাগ বড়–য়া বলেন, ‘কাপ্তাই হ্রদ রাঙামাটির একটা বড় সম্পদ। কিন্তু ক্রমাগত হ্রদের পানির দূষণ বাড়ার ফলে মৎস্য সম্পদ ও ব্যবহার্য পানির ক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। বিশেষত কাপ্তাই হ্রদে সেসব লঞ্চ-বোট চলাচল করে। হ্রদ এলাকার পাশর্^বর্তী ঘরবাড়ি ও ঘনবসতি এলাকায় পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো নয়। সেফটি ট্যাংকির ময়লা যাচ্ছে সরাসরি কাপ্তাই হ্রদে; এসব কারণে হ্রদের পানির মান কমছে। তারমধ্যে গাছের এমন বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অন্যতম বিরূপ প্রভাব ফেলছে।’

এ বিষয়ে জানতে পার্বত্য চট্টগ্রাম দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) ড. জাহিদুর রহমান মিয়াকে একাধিকবার কল দিয়েও পাওয়া যায়নি। তবে বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক গঙ্গা প্রসাদ চাকমা জানিয়েছেন, ‘রাঙামাটি শহর এলাকায় যে করাতকল গুলো রয়েছে সেগুলোর দক্ষিণ বন বিভাগের অধীন। করাতকল চালুর ক্ষেত্রে বন বিভাগ ও প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয়। তবে করাতকল গুলো বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে আমাদের কোনো নির্দেশনা নেই।’

রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন খান বলেন, ‘করাতকলের এসব বর্জ্য তো রান্নার কাজে জ¦ালানি হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। এ বিষয় নিয়ে কী করা যায় বিষয়টি আমরা ভেবে দেখব।’ তবে এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পরিবেশ অধিদপ্তর রাঙামাটি জেলার অতিরিক্ত দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ফোনে একাধিকবার কল দিয়েও তাকে পাওয়া যায়নি।


রাঙামাটি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions