শুক্রবার | ২৯ মার্চ, ২০২৪

মাছ উৎপাদনে জৌলুস হারিয়েছে কাপ্তাই হ্রদ

প্রকাশঃ ১৮ মে, ২০২২ ০৭:২৮:৫১ | আপডেটঃ ২৭ মার্চ, ২০২৪ ০৮:০৫:৪৫  |  ৯২৮
সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। কার্প জাতীয় মাছের প্রাকৃতিক উৎপাদন হ্রাস, অন্যান্য মাছ উৎপাদনে প্রতিবন্ধকতা এবং হ্রদে নাব্যতা সংকটসহ নানান কারণে মৎস্য উৎপাদনে জৌলুস হারিয়েছে কাপ্তাই হ্রদ। গত দুবছর ধরে কাপ্তাই হ্রদের মাছ উৎপাদন রেকর্ড পতন হয়েছে।

কাপ্তাই হ্রদে গত পাঁচ মৌসুমের মাছ অবতরণের বার্ষিক হিসাবে তিন মৌসুম ধরে ক্রমান্বয়ে অবতরণ রেকর্ড হলেও দুই মৌসুম ধরে পতন ঘটেছে। এতে করে সরকারের রাজস্ব আয়ও তুলনামূলকভাবে কমেছে। এদিকে বিএফডিসির কর্মকর্তারা বলছেন, কাপ্তাই হ্রদে পানিস্বল্পতার কারণে গত দুই মৌসুমে মাছ আহরণ মৌসুম শুরুর নির্ধারিত সময়ের পর মাছ ধরা শুরু হওয়ায় বার্ষিক হিসাবে মাছ অবতরণ কমেছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বৃহৎ কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদ। রাঙামাটির আট উপজেলা ও খাগড়াছড়ি জেলার দুই উপজেলা এই হ্রদ তীরবর্তী হওয়ার কারণে ভৌগোলিকভাবে রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি জেলার দশ উপজেলা নিয়ে কাপ্তাই হ্রদ বিস্তৃীর্ণ। কাপ্তাই হ্রদ দেশের অভ্যন্তরীণ বদ্ধজলাশয়সমূহের মধ্যে বৃহৎ। প্রায় ৬৮ হাজার ৮০০ হেক্টর আয়তনের এই হ্রদটি দেশের পুকুরসমূহের মোট জলাশয়ের প্রায় ৩২ শতাংশ এবং অভ্যন্তরীণ মোট জলাশয়ের প্রায় ১৯ শতাংশ। ১৯৬১ সালে রাঙামাটির কাপ্তাই উপজেলায় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষে এই হ্রদের সৃষ্টি হলেও এটি মৎস্য উৎপাদন ও স্থানীয় জনসাধারণের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে। হ্রদের উপর নির্ভরশীল রাঙামাটি-খাগড়াছড়ির প্রায় ২৫ হাজার জেলে পরিবার। মৎস্য উৎপাদনের মধ্যদিয়ে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এই হ্রদটি। তবে ক্রমশ জৌলুস হারাতে বসেছে কাপ্তাই হ্রদ।

বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) সূত্র জানায়, কাপ্তাই হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের বংশবৃদ্ধি, হ্রদে অবমুক্ত করা পোনা মাছের সুষম বৃদ্ধি, মাছের প্রাকৃতিক প্রজনন নিশ্চিতকরাসহ হ্রদের প্রাকৃতিক পরিবেশে মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধির সহায়ক হিসাবে গড়ে তোলার লক্ষে প্রতিবছরের পহেলা মে থেকে ৩১ জুলাই পর্যন্ত কাপ্তাই হ্রদে তিন মাস মাছ শিকারে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়। বছরের আগস্ট থেকে শুরু হয় নতুন মৌসুম। আগস্ট থেকে পরবর্তী বছরের এপ্রিল পর্যন্ত এই নয়মাসকে মৌসুম ধরা হয়। তবে পানিস্বল্পতার কারণে ২০২১-২২ মৌসুমে একমাস দেরিতে মাছ আহরণ শুরু হয়। সেক্ষেত্রে এ মৌসুমে হ্রদ হতে মাছ আহরণ করা হয়েছে মূলত আটমাস। এর আগে ২০২০-২১ মৌসুমেও একই কারণে ১০ দিন দেরিতে মাছ আহরণ শুরু হয়; এ মৌসুমেও উল্লেখজনকভাবে মাছ অবতরণ হ্রাস হয়েছে।

বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের তথ্যমতে, চলতি ২০২১-২২ মৌসুমে কাপ্তাই হ্রদ হতে ৬ হাজার ৫০৩ টনের অধিক মাছ অবতরণ করা হয়েছে। এর বিপরীতে বিএফডিসির রাজস্ব আদায় হয়েছে ১১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। এছাড়া ২০২০-২১ মৌসুমে ৬ হাজার ৭৯৪ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১২ কোটি ১৩ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। এর আগের ২০১৯-২০ মৌসুমে ৮ হাজার ৫৬২ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১৫ কোটি ৩৬ লাখ; ২০১৮-১৯ মৌসুমে ৮ হাজার ৪৫৭ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১২ কোটি ৭৮ লাখ; ২০১৭-১৮ মৌসুমে ৮ হাজার ১১৪ টন মাছ অবতরণের বিপরীতে ১২ কোটি ৪২ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির মৎস্য অবতরণের বার্ষিক হিসাব বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০১৭-১৮ মৌসুম থেকে ২০১৯-২০ মৌসুম পর্যন্ত এই তিন মৌসুমে অবতরণ ও রাজস্ব আদায় দুটোই বেড়েছে। তবে ২০২০-২১ মৌসুমে অবতরণ ও রাজস্ব আদায়ে ধাক্কা লেগেছে। এক মৌসুমের ব্যবধানে অবতরণ কমেছে প্রায় ১ হাজার ৮০০ টন। অন্যদিকে ২০২১-২২ মৌসুমে অবতরণ কমেছে ২ হাজার টনের অধিক। অবতরণকৃত বিভিন্ন প্রজাতির মাছের মধ্যে কেঁচকি, চাপিলা ও মলাসহ দেশীয় প্রজাতির মাছের আধিক্য থাকলেও কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন উল্লেখজনক বাড়েনি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ মৎস্য উন্নয়ন করপোরেশন (বিএফডিসি) রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের সহকারী বাজারজাতকরণ কর্মকর্তা শোয়েব সালেহীন জানান, ২০২১-২১ অর্থবছরে ৬ হাজার ৫০৩ টনের অধিক মাছ অবতরণের বিপরীতে ১১ কোটি ৬৫ লাখ টাকা রাজস্ব আদায় হয়েছে। চলতি মৌসুমের প্রথম মাস পুরো আগস্টজুড়ে মাছ আহরণ বন্ধ থাকার কারণে এ মৌসুমে জেলেরা মাছ আহরণ করেছে আটমাস। যে কারণে মাছ অবতরণ ও রাজস্ব আদায় দুটোই কমেছে। এর আগের বছরেও প্রথম ১০দিন আহরণ বন্ধ থাকায় একই সংকট দেখা দিয়েছে। তবে আমরা আশাবাদী আগামী মৌসুমগুলো এই সংকট কাটিয়ে উঠতে পারব।

এদিকে নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক বিএফডিসি রাঙামাটি বিপণনকেন্দ্রের একাধিক মৎস্য ব্যবসায়ী জানান, কাপ্তাই হ্রদে মৎস্য উৎপাদনের লক্ষে কার্যকর উদ্যোগ না নিলে উৎপাদন সক্ষমতা বাড়ানো যাবে না। আবহাওয়া ও জলবায়ুজনিত কারণে গত দুই আহরণ মৌসুমে দেরিতে মাছ ধরা শুরু হয়েছে সেটি সত্য। তবে কাপ্তাই হ্রদে বিএফডিসির ধারাবাহিক মৎস্য উৎপাদনের জন্য সুষ্ঠু পরিকল্পনার ঘাটতি রয়েছে। বিগত সময়ে দেখা গেছে তিনমাস মাছ ধরা বন্ধ থাকে, এরমধ্যে এক মাস পার হলে কিংবা প্রথম মাসের শেষ দিকে হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের পোনা ছাড়া হয়। এতে করে পোনামাছগুলো বেড়ে উঠার সময় পায় মাত্র মাস দুয়েক। এরপর এসব পোনা মাছ জেলেদের জালে ধরা পড়ে নিধন হয়। কিন্তু মাছ ধরা শুরু হওয়ার পর বিএফডিসি এসব নিয়ে তদারকি করে না। এভাবে গতানুগতিকভাবে কেবল পোনামাছ ছেড়ে হ্রদে কার্পজাতীয় মাছের উৎপাদন বাড়বে না। পূর্বের সময়ে কাপ্তাই হ্রদ থেকে বড় আকারের চিতল, বোয়ালসহ অন্যান্য বড় মাছ পাওয়া গেলেও এখন সেই জৌলুস আর নেই।



অর্থনীতি |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions