বৃহস্পতিবার | ২১ নভেম্বর, ২০২৪
বিশেষ প্রতিবেদন

দুই প্রশাসনের অলিখিত দ্বন্দ্বে ঋণ পাচ্ছেন না বাজারফান্ড এলাকার বাসিন্দারা

প্রকাশঃ ৩০ এপ্রিল, ২০২২ ০১:১৯:৪৩ | আপডেটঃ ২০ নভেম্বর, ২০২৪ ০৮:১৪:২৭  |  ৩৫০৫
 ষ্টাফ রিপোর্টার, রাঙামাটি। পার্বত্য জেলা পরিষদ এবং জেলা প্রশাসনের অলিখিত দ্বন্দ্বে বাজারফান্ড এলাকার লোকজন ব্যাংক ঋন থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন, এতে ব্যবসায়ী ও সাধারন মানুষের মাঝে বাড়ছে ক্ষোভ। বাজারফান্ড জেলা পরিষদে হস্তান্তরিত হওয়ার পর থেকে জায়গা বন্দোবস্তী প্রাপ্ত দলিল বন্ধক ও মর্গেজ রেখে ঋন সুবিধা পেলেও ২০১৯ সনের ডিসেম্বর থেকে জেলা প্রশাসন অলিখিতভাবে বাজার ফান্ডের জায়গা রেজিষ্ট্রেশন বন্ধ করে দেয়, এরপর থেকে বাজারফান্ডের জায়গার উপর ঋণ প্রদান কার্যক্রম স্থগিত রাখে সরকারি বেসরকারি ব্যাংকসমূহ।

অনুসন্ধানে জানা গেছে,  গভর্ণমেন্ট অব ইন্ডিয়ার অর্থ ও বাণিজ্য বিভাগের ১৯৮৫ খ্রিষ্টাব্দের আদেশ অনুযায়ী বাজার ফান্ড হচ্ছে পার্বত্য চট্টগ্রামের বাজার থেকে খাজনাপত্রাদি ও অন্যান্য কর বাবদ প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে বাজার সমুহ উন্নয়ন এবং ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্যে সংগঠিত একটি স্বতন্ত্র স্থানীয় ফান্ড। পরবতীতে ১৯৩৭ খ্রিষ্টাব্দের বাজার ফান্ড বিধিমালা অনুযায়ী বাজার ফান্ড পরিচালিত হচ্ছে। বাজারফান্ড সৃষ্টির পর জেলা প্রশাসকগণ বাজারফান্ডের প্রশাসক হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। ১৯৮৯ সনে পার্বত্য জেলা পরিষদ সৃষ্টির পর বাজারফান্ড জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়। ১৯৮৯ সনের ১৯ জুলাই ভুমি  মন্ত্রণালয় এক প্রজ্ঞাপনে তৎকালীন স্থানীয় সরকার পরিষদকে হাট বাজার স্থাপন, নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাক্ষেনের ক্ষমতা দেয়। ওই প্রজ্ঞাপনের আলোকে তৎকালীন জেলা প্রশাসক ও বাজার ফান্ড প্রশাসক শফিকুল ইসলাম বাজার ফান্ড নামীয় তহবিল তৎকালীন জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান গৌতম দেওয়ানকে হস্তান্তর করেন।  এরপর থেকে জেলা পরিষদের একজন ভুমি কর্মকর্তা বাজার ফান্ডের কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করে আসছেন।

বাজার ফান্ডের মুল কাজ হচ্ছে  হাট বাজার স্থাপন, নিয়ন্ত্রণ ও রক্ষণাবেক্ষন, বাজার চৌধুরী নিয়োগ, উন্নয়ন, দোকানের প্লট বরাদ্দ এবং বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম করা, একই সাথে বাজার ফান্ড বিধিমালার ১৯ বিধি অনুযায়ী বাজার ফান্ড এলাকায় ভুমি বন্দোবস্তী দিয়ে থাকে। এক্ষেত্রে প্রয়োজন বোধে বাজারফান্ড প্রশাসকগণ পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধিমালা ১৯০০ সনের ৩৪ বিধি অনুসরন করে থাকেন।

২০০১ সনের আগ পর্যন্ত বাজার ফান্ড এলাকায় স্থায়ী বন্দোবস্তী দেয়া হয়, ২০০১ সনের ২৩ অক্টোবর পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ভুমি বন্দোবস্তী বন্ধ রাখা হয়। তবে এরপর বাজার ফান্ড কর্তৃপক্ষ দোকান প্লট বা জায়গা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিয়ে ১০ বছরের জন্য লিজ দিয়ে থাকে। 

ব্যাংক ঋণের ক্ষেত্রে স্থায়ী পার্বত্য জেলা পরিষদ বাজারফান্ডের জায়গায় অনাপত্তি দিলে জেলা প্রশাসকগণ রেজিষ্ট্রেশন দিয়ে থাকেন এবং এরমাধ্যমে জায়গার দাবিদার ব্যাংক ঋণ পেয়ে থাকেন। পার্বত্য চুক্তির পরও এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত ছিলো। কিন্তু ২০১৯ সনের ডিসেম্বর মাসে অলিখিতভাবে বাজারফান্ডের জায়গা রেজিষ্ট্রেশন বন্ধ করে দেন তৎকালীন জেলা প্রশাসক। পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, জেলা পরিষদ আইন, বাজার ফান্ড আইন ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি এসবের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় এবং আইনগুলো সংশোধন বা বাতিল না হওয়ায় বিভিন্ন সময় সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় একেক  জেলা প্রশাসক আইনের বিভিন্ন আইনের ভিন্নতা প্রয়োগ করেন। আর এতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় সাধারন মানুষ।

কেবল রাঙামাটি নয়, অপর দুই জেলা খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানেও একই অবস্থা আইনী ম্যারপ্যাচে বাজারফান্ডের আওতাধীন প্লট বা জায়গার ঋণ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে।

বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও দৈনিক রাঙামাটির প্রকাশক জাহাঙ্গীর কামাল বলেন, আমি ২৬ বছর ধরে ব্যবসা করে আসছি, রাঙামাটি শহরের ৮০ শতাংশ জায়গা বাজার ফান্ডের, আমরা ব্যবসার প্রয়োজনে জায়গা বন্ধক বা মর্গেজ রেখে ব্যাংক ঋণ নিয়ে থাকি। গত ৩ বছর ধরে বাজারফান্ড এবং জেলা প্রশাসনের জটিলতার কারণে আমরা ব্যাংক ঋণ পাচ্ছি না,  এতে আমরা ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। আমার মনে হচ্ছে পাহাড়ী বাঙালী বিভেদ সৃষ্টির জন্য অদৃশ্যে একটা শক্তি কাজ করছে।

রাঙামাটি শহরের তবলছড়ি বাজার সমিতির সাধারন সম্পাদক নাজিম উদ্দিন জানান, আমি ব্যবসায়িক সিসি লোনের জন্য একটি ব্যাংকে ১৫ লক্ষ টাকা অনুমোদন করাই, কিন্তু বাজার ফান্ড আর জেলা প্রশাসনের দ্বন্দ্বের কারণে ব্যাংক থেকে ঋণ পাচ্ছি না। ব্যাংক বলছে , জেলা প্রশাসন থেকে ক্লিয়ারেন্স না দিলে তারা ঋণ দিবে না। আমরা দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। এর সুরাহা করা দরকার।

অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী শামীম জাহাঙ্গীর জানান, প্রত্যেক কর্মচারীর একটা আশা থাকে জীবনের শেষ বয়সে এসে একটা ভালো বাসা বা ঘর করা, আমারও সে রকম ইচ্ছা ছিলো। আমি ৪তলা ফাউন্ডেশন দিয়ে ১ তলা ভবন করেছি, আমার ইচ্ছা ছিলো এটিকে আরো বড় করা, ব্যাংকে ঋণের জন্য আবেদনও করেছি, কিন্তু এই ব্যাংক ওই ব্যাংক করতে করতে আমার পা ব্যাথা হয়ে গেছে, কিন্তু ঋণ পায়নি। 

রাঙামাটি আইএফআইসি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার সোহেব রানা ও ইউসিবি ব্যাংকের ব্যবস্থাপক খালেদ মোরশেদ হিরো জানান, আমরা বেসরকারি ব্যাংকগুলো এসেছি ব্যবসা করতে, মানুষের সেবা করতে। কিন্তু মানুষকে সেবা করতে গেলে নানা আইনী জটিলতায় পড়তে হয়। ব্যাংকাররা সব সময় আগে দেখেন জায়গার মুল্য যেখানে বেশী, ঋণের ক্ষেত্রে সে সব জায়গাকে অগ্রাধিকার দিতে , রাঙামাটিতে বাজার ফান্ড এলাকার জায়গাগুলো দাম বেশী এবং এক্ষেত্রে হাউজ বা ব্যাক্তি ঋণ বেশী পাওয়া যায়, আমরা অনেক ঋণও দিয়েছি কিন্তু ২০১৯ সনের ডিসেম্বর  থেকে জেলা প্রশাসন মর্গেজ পারমিশন দিচ্ছে না, এতে করে আমরা ঋণ দিতে পারছি না। এতে ব্যবসায়ীরা ঋণ না পাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে অন্যদিকে ব্যাংকও ব্যবসা করতে পারছে না।

রাঙামাটি চেম্বার অব কমার্স ইন্ডাষ্ট্রিজের সভাপতি আব্দুল ওয়াদুদ জানান, সাবেক জেলা প্রশাসক আমাদের বলেছিলেন, জেলা পরিষদ ভুমি রেজিষ্ট্রেশন দিতে পারে না, জেলা প্রশাসন দিবে, বিষয়টি আমরা মন্ত্রণালয়ে লিখেছি সেখান থেকে সুরাহা হলে আমরা ক্লিয়ারেন্স দিব, অথচ শান্তি চুক্তি, জেলা পরিষদ আইন সবকিছুতে আইন অনুযায়ী বাজার ফান্ড জেলা পরিষদে হস্তান্তর করা হয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসকের সাথে যোগাযোগ করেছি,  এমপি মহোদয় জেলা প্রশাসককে বলেছেন, এরপরও জেলা প্রশাসক ঋণের জন্য রেজিষ্ট্রেশন দিচ্ছেন না। ব্যবসায়ী ও সাধারন মানুষ ঋণ না পাওয়ায়  এখানে এক ধরণের অরাজকতা বিরাজ করছে।

তিনি আরো জানান, গত আড়াই বছরে ঋণের জন্য প্রায় ১,৬০০ আবেদন ব্যাংকে জমা পড়েছে, প্রশাসন যদি এর সুরাহা না করে তাহলে আমরা ঈদের পরে আন্দোলনে নামব।

বিষয়টি নিয়ে খুব বেশী কথা বলতে না চাইলেও রাঙামাটি জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান  জানিয়েছেন, এটা তো আমি আসার আগ থেকে চলে আসছে, এটা লিগ্যাল ইস্যু। এটা বন্ধ আছে বেশকিছুদিন ধরে। বিষয়টি নিয়ে ভুমি, আইন, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়েছে। এখানে ভুমি ও আইন মন্ত্রণালয় মতামত দিয়েছে আইনগতভাবে লিজ নেয়া জায়গার রেজিষ্ট্রেশন দেয়ার সুযোগ নেই। এটা এখন মন্ত্রণালয় সিদ্ধান্ত দিবে, আমাদের কিছু করার নেই।

বাজারফান্ড প্রশাসক ও রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অংসুই প্রু চৌধুরী জানিয়েছেন, সমস্যাটা ব্যাংকের ঋণ নিয়ে, ঋণ নিতে গেলে ব্যাংকের কাছে জায়গার কাগজ মর্গেজ রাখতে হয়। সেক্ষেত্রে আমরা মর্গেজের অনুমোদন দিলে রেজিষ্ট্রেশন কর্মকর্তা হিসাবে জেলা প্রশাসন রেজিষ্ট্রেশন করে দিবেন, এটা এভাবে হয়ে আসছে। এখন জেলা প্রশাসকরা কেন রেজিষ্ট্রেশন দিচ্ছেন না, তারাই বলতে পারবেন, আমি মন্ত্রণালয়ের বৈঠকেও অনুরোধ করেছিলাম, এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারন জনগণ, আমরাও অস্বস্তিকর পরিবেশে আছি।

তিনি আরো জানান, এব্যাপারে মন্ত্রণালয়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে, উনারা  (জেলা প্রশাসকগণ) যেটা যুক্তি দেখান বাজার ফান্ডের বন্দোবস্তী স্থায়ী না লিজ ভিত্তিক, তাই তারা রেজিষ্ট্রেশন দিচ্ছেন না, কিন্তু রাঙামাটি বাজারফান্ড স্থায়ী ভিত্তিতে বন্দোবস্তী দিয়েছে। কেবল ব্যবসায়িক প্লটের ক্ষেত্রে ১০ বছর লিজ দেয়া হয়েছে, অন্যান্য জেলা পরিষদের দেয়া বন্দোবস্তী অস্থায়ী হলেও রাঙামাটিতে স্থায়ীভাবে দেয়া হয়েছে। আর বাজারফান্ড যখন ব্যাংক ক্লিয়ারেন্স দেয় তখন জেলা প্রশাসনের আপত্তি থাকার কথা না। আমরা মন্ত্রনালয়ের বৈঠকেও রেজিষ্ট্রেশন দেয়ার জন্য অনুরোধ করেছি।

কেবল বাজার ফান্ড নয়, পার্বত্য চট্টগ্রাম ১৯০০ সালের রেগুলেশন, জেলা পরিষদ আইন ও পার্বত্য শান্তি চুক্তি এসবের মধ্যে সমন্বয় না থাকায় এবং আইনগুলো সংশোধন বা বাতিল না হওয়ায় বিভিন্ন সময় প্রশাসনিক জটিলতা সৃষ্টি হয়, এর সমাধান চান পাহাড়ের জনগণ।


বিশেষ প্রতিবেদন |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions