অনন্ত বিহারী খীসা (এবি খীসা) পাহাড়ের এক নিভৃতচারী শিক্ষাবিদ। তিনযুগের অধিক শিক্ষকতার জীবন শেষ করেছেন ১৯৯৫ সনে। ১৯৩৭ সালের ৫ নভেম্বর খাগড়াছড়ি জেলার মহালছড়ি উপজেলার মুবাছড়ি নামক দুর্গম এক পাহাড়ী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শতাব্দী প্রাচীন খবংপর্যা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাঁর পাঠশালা জীবন শুরু। পাহাড়ের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে তিনি এক নেপথ্যের প্রতিভূ। পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম রাজনৈতিক সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জন সমিতি’র গঠন প্রক্রিয়ায় তিনি তরুণ বয়সেই শামিল হয়েছিলেন। প্রয়াত কামিনী মোহন দেওয়ান জনসমিতির নেতৃত্ব দিলেও অনন্ত বিহারী খীসার প্রণোদনায় একঝাঁক তরুণ এই প্রক্রিয়ায় রাজনীতির পাঠ নেন। একই সাথে তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রথম ছাত্র সংগঠন ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সমিতি’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন।
অনন্ত বিহারী খীসা জানান, আমি যখন ১৯৫৩ সালে রাঙ্গামাটি সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে মাধ্যমিক উত্তীর্ণ হই তখন কাপ্তাই বাঁধ দেয়ার জন্য পাকিস্তান সরকার গোপনে প্রস্তুতি নিচ্ছিল। চট্টগ্রামের ‘কানুনগোপাড়া সরকারি স্যার আশুতোষ কলেজ’-এ পড়ার সময় পাশ্ববর্তী শ্রীপুর গ্রামে পাহাড়ি ছেলেদের একটি মেস ছিল। এখানে উল্লেখ্য যে, পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিকাংশ কীর্তিমান মানুষ এই কলেজেই পড়তেন। ছাত্র সমিতির নেতৃত্বেই তৎকালীন সরকারের কাছে শিক্ষা সংক্রান্ত দাবি দাওয়া নিয়ে অনেকগুলি স্মারকলিপি দেওয়া হয়েছিল। এই কথা স্বীকার করতেই হয়, পাকিস্তান সরকার এই সকল দাবি দাওয়ার খোঁজ খবর নিতেন না। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান ‘মার্শাল-ল’ জারি করলে এই সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ন দলিলপত্র হারিয়ে যায়। যখন কাপ্তাই বাঁধ হয় সেই ১৯৬০ সালেই অনন্ত বিহারী খীসা খাগড়াছড়ি হাইস্কুলে শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। যদিওবা ১৯৫৮ সালেই বিপুলেশ্বর চাকমার (পন্ডিত স্যার) নেতৃত্বে স্কুল যাত্রা শুরু করে। এই সময় অশোক কুমার দেওয়ান, নবীন কুমার ত্রিপুরা এই স্কুলে শিক্ষক ছিলেন।
কাপ্তাই বাঁধ প্রসঙ্গে অনন্ত বিহারী খীসা বলেন, এটি একটি জীবন্ত মরণ ফাঁদ। আজকের এই দিনে পৃথিবীর যেকোন জায়গায় এরকম একটি বাঁধ হলে বিশ^ব্যাপী আন্দোলন দানা বাঁধতো। আবেগ আপ্লুত হয়ে তিনি জানান, কাপ্তাই বাঁধের ফলে এক লক্ষ চাকমা উদ্ধাস্তু হয়ে ভারত পালিয়েছে। চুয়ান্ন হাজার একর উর্বর ভূমি পানির নিচে ডুবে গেছে। সে সময় সবচেয়ে ভাল জমির একর প্রতি ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়েছিল মাত্র ৬’শ টাকা। এ যেন রূপকথার গল্পকেও হার মানায়। অনন্ত বিহারী খীসা কাপ্তাই বাঁধ চলাকালীন সময়ের জেলা প্রশাসক ছিদ্দিকুর রহমানের পত্রিকায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন - তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের কাছে আঠাশ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণ দাবি করেছিলাম। কিন্তু সরকার দিয়েছিল মাত্র এক কোটি ছিয়ানব্বই লক্ষ টাকা। ছিদ্দিকুর রহমান লিখেন, জনচাপে আমি সরকারের কাছে আরও কিছু টাকা বরাদ্দের আবেদন জানালে সরকারের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হয় “ওরা জঙ্গলী লোক। জঙ্গলের ঘাস, লতা-পাতা আর আলু খেয়ে জীবন ধারণ করতে পারবে।”
অনন্ত বিহারী খীসা সত্তরোর্ধ্ব বয়সেও কাপ্তাই বাঁধের বেদনাময় স্মৃতি ভুলতে পারেননি। তিনি স্বীকার করেন, কাপ্তাই বাঁধের ফলে অনেক দুর্গম এলাকায় রাতারাতি নৌ যোগাযোগ সৃষ্টি হয়েছে। সর্বহারা চাকমাদের মাঝে শিক্ষার প্রতি অদম্য এক স্পৃহা জেগে উঠে। এই সময় পাকিস্তান সরকার বাঁধে ক্ষতিগ্রস্থ জনগোষ্ঠীর জন্য উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় বরাদ্দ দেন। অনন্ত বিহারী খীসা কাপ্তাই বাঁধের পরিবেশগত বিপর্যয় সম্পর্কে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রাম উপমহাদেশের গুরুত্বপূর্ন একটি প্রাকৃতিক সূতিকাগার ছিল। রাতারাতি বাঁধ দিয়ে এই অঞ্চলের হাজার বছরের ভৌগলিক-প্রাকৃতিক পরিবেশকে বিনষ্ট করে বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হল। তিনি উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, পার্বত্য চট্টগ্রামের কত শতাংশ মানুষ এখন বিদ্যুৎ পাচ্ছে। যাদের চোখের লোনা জলে কাপ্তাই বাঁধ হয়েছে সেসব অবুঝ মানুষদের কয়জন বংশধর বিদ্যুৎ প্রকল্পে চাকরি পেয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা যে প্রতিবাদ করিনি তা নয়। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা (প্রয়াত সংসদ সদস্য এমএন লারমা) সেই সময় প্রতিবাদ করার কারণে গ্রেফতার হন। মূলত চাকমাদের সামন্ত শ্রেণী পরোক্ষভাবে পাকিস্তান সরকারের অনুকম্পাকামী হওয়ায় সাধারণ মানুষের সংগঠিত প্রতিবাদ সূচিত হতে পারেনি। তিনি বলেন, এখন সমতলের মানুষের যতবেশী পার্বত্য অঞ্চলের খোঁজ-খবর রাখেন তখন এটা কল্পনা করা যেত না। আমাদের যাঁরা প্রবীণ মানুষ ছিলেন তাঁরা প্রস্তাব করেছিলেন বাঁধটি আরো নীচে দিলে ক্ষয়ক্ষতি কম হত। কিন্তু তা হয়নি। সে সময়ে পাহাড়িদের সচেতন অংশ এই বাঁধ দেয়ার উদ্যোগটিকে পাহাড়ি উচ্ছেদের অংশ বলেই ধরে নিয়েছিল। কাপ্তাই বাঁধ নির্মানে আমেরিকান দাতা সংস্থা ‘ইউএসএইড’-এর অর্থায়ন প্রসঙ্গে বলেন, তারা অবশ্যই পরোক্ষভাবে দায়ী। তবে মূলদোষী পাকিস্তান সরকারই। তিনি দৃঢ়তার সাথে মত ব্যক্ত করেন, কাপ্তাই বাঁধের মধ্য দিয়ে পাহাড়িদের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার সম্পর্কে বড় রকমের জানান হয়েছে। অনন্ত বিহারী খীসা মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে গ্রেফতার হন। এই সম্পর্কে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাহাড়ে বিশেষত চাকমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী হিসাবে চিহ্নিত করার একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়। দেশ স্বাধীনের আগে আগে মুক্তিবাহিনী পানছড়ি, জোরমরম, ভাইবোনছড়াসহ বেশ কিছু এলাকায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী এবং পাকিস্তানপন্থি আখ্যা দিয়ে চাকমাদের উপর ব্যাপক গণহত্যা চালায়। এই গণহত্যায় পৈশাচিকতার মাত্রা এত ভয়াবহ ছিল যে আহত লোকজন হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হওয়ার সাহস করেনি। গোপনে এসকল মূমুর্ষ মানুষদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করার অভিযোগে আমাকে মিথ্যা মামলায় জেল খাটানো হয়েছে। অনেকটা জনপ্রতিক্রিয়ার চাপেই আমাকে মুক্তি দিতে হয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকালীন চাকমাদের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, চাকমাদের রাজনৈতিক সচেতন অংশ গোড়া থেকেই পাকিস্তান বিরোধী দলে ছিল। এমনকি ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়ও রাঙামাটিতে ভারতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল।
পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসমিতি ১৯৪৯-৫০ সালেও কামিনী মোহন দেওয়ান এবং স্নেহ কুমার চাকমা’র নেতৃত্বে পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন করেছিলেন। এখানে সবার জানা থাকার কথা যে চাকমা ও বোমাং রাজপরিবার পাকিস্তানমুখী ছিলেন। তখন সাধারণ পাহাড়িদের মাঝে রাজপরিবারগুলোর ব্যাপক প্রভাব ছিল। অনেকটা রূপকথার রাজার মত। চাকমাদের ব্যাপক অংশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নেওয়া প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তৎকালীন পার্বত্য চট্টগ্রাম আওয়ামীলীগের সেক্রেটারী ছিলেন সাইদুর রহমান নামের এক পাহাড়ি বিদ্বেষী মানুষ। যদিওবা চারু কুমার চাকমা নামে মাত্র ঐ কমিটির সভাপতি ছিলেন। এই সময় রাঙ্গামাটির ডিসি ছিলেন হোসেন তৌফিক ইমাম প্রকাশ এইচ টি ইমাম। চাকমা তরুণদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ট্রেনিংএ যাওয়ার ইচ্ছা ব্যক্ত করলে সাইদুর রহমান এবং প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাঁদের তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে বিদায় দেয়া হয়। এমনকি রাজা ত্রিদিব চন্দ্র রায়ের নাম ধরে বলেন, চাকমারা মুসলিম লীগের দালাল। প্রথম প্রথম রাজা ত্রিদিব রায়ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষেই ছিলেন বলে মত প্রকাশ করেন অনন্ত বিহারী খীসা। যথাযথ সম্মানবোধের অভাবেই এই দূরত্ব তৈরী হয়েছে। অনন্ত বিহারী খীসা উল্লেখ করেন, চাকমা সমাজের সামন্ত শ্রেণীর আত্ম-সম্মান তখন খুব প্রবল ছিল। এক পর্যায়ে পাকিস্তান আর্মিকে রাঙ্গামাটিতে রাজা ত্রিদিব রায় স্বাগত জানালে চাকমাদের বিপুল অংশ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি নিস্পৃহ হয়ে উঠে এবং রাজা নিজে ‘জাতিসংঘ মিশন’-এ পাকিস্তানের প্রতিনিধিত্ব করেন। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতির প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর স্বীকৃতি দাবি জানান তৎকালীন সংসদ সদস্য এম এন লারমা। একই সাথে চারু কুমার চাকমার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে বেশ কিছু দাবি দাওয়া তুলে ধরা হয়। এরকম একটা প্রতিনিধি দলে আমিও (অনন্ত বিহারী খীসা) ছিলাম কিন্তু সংসদে এবং সংসদের বাইরে এইসব দাবিকে প্রত্যাখান করা হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সামনেই এমএন লারমা ও চারু কুমার চাকমাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন, ‘আমি কাউকে পৃথক করার চিন্তা করছি না। আমি পাহাড়ি-বাঙালি সকলকে সমানভাবে দেখার স্বপ্ন দেখছি’।
অনন্ত বিহারী খীসা জানান, এই সময়ে আমরা একটি স্বতন্ত্র আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন বোধ করি। আমার বাসায় বেশ কয়েকটি বৈঠকের মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হয়, আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আমরা জাতীয় রাজনীতিতেও সমানভাবে অংশ নেব। দেশ স্বাধীনের একটু আগে আমাকে সভাপতি এবং সন্তু লারমাকে সম্পাদক করে ‘ট্রাইবেল ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন’ গঠনের পর সবাই দ্রুত দল গঠনে মনোযোগ দেন। ‘৭২ সালের কোন এক দিনের রাঙ্গামাটির ইন্দ্রপুরী সিনেমা হলে পাহাড়ের বিশিষ্টজনদের নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয় পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি। সে সময় নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তরুণদের একটি অংশ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়েই গোপনে অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। অনন্ত বিহারী খীসা মনে করেন, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন এবং পরবর্তী সময়ে পাহাড়িদের উপর পাহাড়ি রাজাকারদের অত্যাচার দমন ও পাড়ায় পাড়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠায় সংগঠিত তরুণরাই পরবর্তীতে সময়ের প্রয়োজনে শান্তিবাহিনীরূপে আবির্ভূত হয়। বাকশাল- এ যোগদান প্রসঙ্গে অনন্ত বিহারী খীসা বলেন, ‘বাংলাদেশের তৎকালীন বাস্তবতায় বাকশালের প্রয়োজনীয়তা ছিল’। হঠাৎ খবর এলো এনএম লারমা বাকশালে যোগ দিয়েছেন। তিনিই আমাকে বাকশালে যোগ দেয়ার আহ্বান জানান- ‘শেখ মুজিব আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে বলেছেন, আমি আগে তোমাদের সম্পর্কে ভুল জেনেছি। আমি তোমাদের জন্য কিছু করতে চাই।’
অনন্ত বিহারী খীসা আরও বলেন, একদিন হঠাৎ করেই খবর এলো মং রাজা মং প্রু সাইন খাগড়াছড়ির গভর্নর আর আমি বাকশালের সেক্রেটারি মনোনীত হয়েছি। তার একদিন পরেই খাগড়াছড়ির এসডিও স্কুলেই আমাকে সংবর্ধিত করলেন। এই সময়ে ছাত্ররা বাধ সাধল আমি যেন স্কুল ছেড়ে না যাই। তখন আমি ছাত্রদের আশ^স্ত করে বলি, যদি শিক্ষকতা ছেড়ে দিতে হয় তাহলে আমি বাকশাল ছেড়ে দেব। অনন্ত বিহারী খীসা পঁচাত্তর পরবর্তী পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি সম্পর্কে বলেন, এটি একটি রক্তাক্ত সময়। বিপুল পরিমাণ সমতলের দরিদ্র বাংলাভাষিকে পাহাড়ে পুর্নবাসন করা হয়। যা এখনও পর্যন্ত অব্যাহত আছে। তিনি প্রখ্যাত সাংবাদিক সুবীর ভৌমিকের বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, জনসংখ্যা দিয়ে স্বল্প জনসংখ্যাকে নিঃশেষ করার এমন জঘন্য ঘটনা একমাত্র বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামেই ঘটেছে। পৃথিবীতে ঈসরাইল ছাড়া আর কোথাও এর নজির পাওয়া যাবেনা। অনন্ত বিহারী খীসা মিজোরামসহ ভারতে বিভিন্ন রাজ্যে চলমান বিদ্রোহ দমনেও এরকম ‘এথ্িনক ক্লিনজিং পলিসি’ নেওয়া হয়নি বলে মত দেন। তিনি পার্বত্য চট্টগ্রামে নিয়ে আসা বাংলা ভাষীদের প্রসঙ্গে বলেন, বিভিন্ন প্রলোভণ দেখিয়ে সরকার তাঁদের নিয়ে আসলেও তাঁদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। তাঁরা এখনও অসহায়। শুধুমাত্র রেশন দিয়ে এত দীর্ঘ সময় এরকম জনগোষ্ঠীকে পালনের উদাহরণও একমাত্র বাংলাদেশেই হয়েছে। তিনি মনে করেন, পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার দরিদ্র পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর সাথে দরিদ্র বাংলাভাষীদের সংঘাত লাগিয়ে দিয়ে প্রকৃত সমস্যাকে আড়াল করার চেষ্টা করছে। তিনি ১৯৮৯ সালে গঠিত ‘স্থানীয় সরকার পরিষদ (বর্তমানে পার্বত্য জেলা পরিষদ) প্রসঙ্গে বলেন, পরিষদ গঠন প্রক্রিয়ায় আমি প্রথম দিকে সক্রিয় ছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম, এই পরিষদ গঠন প্রক্রিয়ায় কোন স্বাধীন মতামত দেওয়া যাচ্ছিলনা তখন আমি নিস্ক্রিয় হয়ে পড়ি। অন্য এক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তৎকালীন ব্রিগেড কমান্ডার সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম আমার উপর খুবই রুষ্ট হয়েছিলেন। পার্বত্য চুক্তি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, চুক্তির পরে অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল। আশা করেছিলাম অনেক সমস্যার উত্তরণ ঘটবে। চুক্তি স্বাক্ষরের প্রায় একযুগপূর্তি হলেও মনে হচ্ছে যেন, পরিস্থিতি এখন চুক্তির আগের চেয়েও খারাপ। আশাবাদী হওয়ার মত কিছুইতো ঘটেইনি বরং যারা জীবনের মূল্যবান সময়গুলো যুদ্ধে অতিবাহিত করেছেন তাঁদের অনেকেই আজ হতাশ। তবে পার্বত্য চুক্তির বাস্তবায়ন হলে তিনি খারাপ কিছু দেখেন না বলে মত ব্যক্ত করেন।
পার্বত্য অঞ্চলের দুই আঞ্চলিক দল জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ-এর মধ্যকার রক্তাক্ত হানাহানি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অস্ত্রের ভাষায় কোন রাজনীতি হতে পারে না। আমি গোড়া থেকেই আত্মঘাতী সংঘাতের বিপক্ষে। মূলত সরকার পাহাড়ে সশস্ত্র সংঘাত দমনের সূত্র ধরেই সমতলের মানুষদের রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে পাহাড়ে নিয়ে এসেছেন। তিনি এখনও মনে করেন, যেকোন ধরনের অস্ত্র নির্ভর রাজনীতি পার্বত্য চট্টগ্রামের অধিবাসীদের জন্য সুফল বয়ে আনবে না। জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ-এর ঐক্য কামনা করে তিনি বলেন, সাধারণ মানুষ হানাহানির ফলে চরম ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। গত দশ বছরে পাঁচ শতাধিক মানুষ একে অপরের হাতে নিহত হয়েছে। প্রতিবন্ধী হয়েছে অনেকেই। ঘর-বাড়ি পোড়ানো, উদ্ধাস্তু হওয়া আর জীবনের অনিশ্চয়তা পাহাড়িদের জীবন আজ বিপর্যস্ত। তিনি বলেন, আমরা প্রথম থেকেই ঐক্যের উদ্যোগ নিয়েছিলাম। সে প্রক্রিয়ায় প্রয়াত এমপি উপেন্দ্র লাল চাকমা ও প্রয়াত শিক্ষাবিদ নবীন কুমার ত্রিপুরাও নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। অন্তত দুটি রাজনৈতিক দল ইস্যুভিত্তিক ঐক্য ও গণতান্ত্রিক কর্মসূচিতে এক হলে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামের মানুষ উপকৃত হবে।
বাংলাদেশের সার্বিক রাজনীতি ও সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের ভালো মানুষরা এখন রাজনীতিতে অসহায়। এই অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে সৎ, অসাম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল মানুষদের ইস্পাত কঠিন ঐক্য এখন জরুরী। তিনি সর্বশেষ মন্তব্য করেন, জীবন আমাদের নয়। সাংবাদিক কুররাতুল আইন তাহমিনার একটা উদ্ধৃতিই পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য সময় উপযোগী মনে করেন অনন্ত বিহারী খীসা। আর সেই প্রিয় উক্তিটি তিনি উচ্চারণ করেন এভাবে, “বলির পাঁঠা যার- তাঁকে লেজে কাটা আর মুড়োই কাটার সার্বিক অধিকার তারই আছে।”
(সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে বিগত ২০০৮ সালের মাঝামাঝি। এটি কিছু অংশ ওই সময়ে মঈনুল আহসান সাহেবের সম্পাদিত জনপ্রিয় সাপ্তাহিক ২০০০ নামক পত্রিকায় আংশিক প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু ইতিহাস ও সমকালীন বাস্তবতায় সাক্ষাৎকারটি গুরুত্ব এখানে বিদ্যমান। পাঠমনস্ক পাঠকদের কথা মাথায় রেখে কিছু অপ্রিয় সত্য উহ্য রেখে এটি আবারও পূর্ণাঙ্গরূপে প্রকাশ করা হলো। আশা করি এটি ইতিহাসের অংশ হয়ে উঠবে।)
প্রদীপ চৌধুরী: সভাপতি, খাগড়াছড়ি সাংবাদিক ইউনিয়ন (কেইউজে/ রেজি: নং- চট্ট ২৮০৮)