প্রকাশঃ ১৩ জুন, ২০১৯ ১১:১৪:০৫
| আপডেটঃ ১২ অক্টোবর, ২০২৪ ০৯:০৮:০৮
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। দুঃসহ স্মৃতি বেদনার ২০১৭ সালের সেই ভয়াল ১৩ জুন কাল। দিনটি রাঙামাটিবাসীর জন্য খুবই বেদনার। শোকের আর কান্নার। যার ভয়াল চিত্র নিয়ে বয়ে বেড়াচ্ছে রাঙামাটির মানুষ। থামছে না কান্নার নোনা জল। ভয়াবহ সেই পাহাড় ধসের বিপর্যয়ের দুই বছর পেরিয়ে গেল দেখতে দেখতে। কিন্তু আজও ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। আজও অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পড়ছে স্বজন হারা মানুষের চোখ বেয়ে। নিরাপদ আবাসস্থল তৈরি হয়নি ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনের। ঘুরেফিরে আবার এসে গেছে অঝোর বৃষ্টি-বাদল। একই রূপ ধারণ করেছে প্রকৃতি। এতে আবার ভীতি তৈরি হয়েছে ঝুঁকিতে বসবাসকারী মানুষের মনে।
প্রকৃতির ওপর কারও হাত নেই। তবুও তো বাঁচতে তা মোকাবেলা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন মানুষের সতর্কতা ও সচেতনতার পাশাপাশি নিরাপদ স্থান এবং আর্থিক সহায়-সম্বল। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন তো একেবারে নিঃস্ব। তারা যাবেন কোথায়। যাওয়ার থাকলে তো অনেক আগেই সরে যেতেন নিরাপদে। কোথাও তো ঠাঁই হয়নি আজও। সরকার পুনর্বাসনের কথা বললেও গত দুই বছরে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ না থাকায় সেই আশা অনেক আগেই ছেড়ে দিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তা-ঘাটও ঠিক হয়নি গত দুই বছরে। এখন দুর্যোগ মোকাবেলায় সরকারের সর্বাত্মক প্রস্তুতি ও পদক্ষেপ ছাড়া বিকল্প কিছুই নেই। সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসন বলছে, যে কোনো দুর্যোগ মোকাবেলায় সর্বাত্মক প্রস্তুতি রয়েছে। রাঙামাটিতে আর কোনো দুর্যোগে কারও মৃত্যু চায় না কেউ। এখন শুধু সেই ভরসায় এখানকার মানুষ বিশেষ করে ঝুঁকিপূর্ণ লোকজন।
এদিন ভারি বৃষ্টিপাতে ভয়াবহ পাহাড় ধসের দুর্যোগে সদরসহ রাঙামাটি জেলায় ১২০ জনের প্রাণহানি ঘটে। যাদের মধ্যে ছিলেন, দুই পদস্থ কর্মকর্তাসহ পাচ সেনা সদস্য। সেদিনের স্মরণকালের বিপর্যয় কেড়ে নিয়েছে, কারও প্রিয় মা, বাবা, কারও সন্তান, ভাইবোন, স্বামী বা স্ত্রীসহ অনেকের প্রিয় স্বজন। রাস্তাঘটা, বাড়িঘর, স্থাপনা, ফসলি জমি বিধ্বস্ত হয়ে ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ভয়াল ও বেদনার সেই স্মৃতিগুলো আজও তাড়া করছে দুর্যোগগ্রস্ত লোকজনকে।
১২ জুন থেকে অবিরাম শুরু ভারি বৃষ্টিপাত। সঙ্গে বজ্রপাতে প্রকম্পিত হচ্ছিল ভূমি। এরপরও রাত পর্যন্ত মোটামুটি আবহাওয়া অনুকূলে ছিল। পরদিন ১৩ জুন সকাল ৮টা থেকে শুরু হতে থাকে বিপর্যয়। আসতে থাকে একের পর এক প্রাণহানির দুঃসংবাদ। অনবরত পাহাড়ের ভূমি ধসে জীবন্ত কবরস্থ হতে থাকে দুর্যোগের শিকার মানুষ। ভেঙে বিধ্বস্ত হয়ে যাচ্ছিল ব্যাপক রাস্তা ও স্থাপনা। ভূ-গর্ভে ডুবে যাচ্ছে বাড়িঘর। পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়ায়, যা থামানোর মতো কারো কোনো ক্ষমতা ছিল না প্রকৃতির সেই নিষ্ঠুর থাবা। রুদ্ধ হয়ে পড়ে উদ্ধারের পথ। তবুও জীবনবাজি রেখে উদ্ধার কাজে নামেন সেনাবাহিনী, পুলিশ, ফায়ার ব্রিগেডসহ বিভিন্ন সংস্থা ও স্থানীয় লোকজনের উদ্ধারকর্মীরা। একের এক উদ্ধার করা মরদেহে বীভৎস ও হৃদয় বিদারক লাশের স্তুপ জমতে থাকে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে। সব মিলিয়ে সেই দিনের নিষ্ঠুর প্রকৃতি প্রাণ কাড়ে রাঙামাটির ১২০ জনের। রাঙামাটিজুড়ে নিমিষেই ছড়িয়ে পড়ে শোকের মাতম।
রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে উদ্ধার কাজে গিয়ে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন, পাঁচ সেনা সদস্য মেজর মো. মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, কর্পোরাল আজিজুল হক, সৈনিক মো. শাহীন আলম ও মো. আজিজুর রহমান। ওই সময় পাহাড় ধসে মাটিতে চাপা পড়ে তারা তলিয়ে গেছেন ভূ-গর্ভে। পরে একে একে উদ্ধার করা হয় মানবতার সেবায় নিয়োজিত ৫ সেনা সদস্যের মরদেহ।
দুর্যোগের দিন ক্ষতিগ্রস্ত রাঙামাটি সদরের মানিকছড়ি আর্মি ক্যাম্পের সামনে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ধ্বসে পড়া মাটি, গাছ ও ডালপালা অপসারণ করছিলেন ১৫ জনের একদল সেনা সদস্য। নেতৃত্বে ছিলেন, মেজর মো. মাহফুজুল হক ও ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত। তারা ছিলেন রাঙামাটি সদর জোনের অধীন কর্মরত। উদ্ধার কাজ শুরুর অল্প কিছুক্ষণের মধ্যে হঠাৎ পাশের পাহাড় ধসে পড়ে। এতে মাটি চাপায় পড়েন উদ্ধার কাজে নিয়োজিত সেনা সদস্যরা। দুর্যোগে কবলিত হয়ে শহীদ হয়েছিলেন, মেজর মো. মাহফুজুল হক, ক্যাপ্টেন মো. তানভীর সালাম শান্ত, কর্পোরাল আজিজুল হক, সৈনিক মো. শাহীন আলম ও মো. আজিজুর রহমান। এ ছাড়া জীবিত আহত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, সৈনিক আজমল, মোজাম্মেল, মামুন, ফিরোজ ও সেলিম নামে ৫ সেনা সদস্যকে।
রাঙামাটি সেনা রিজিয়ন হতে পাওয়া তথ্য মতে, মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর থানার ইরতা গ্রামের বাসিন্দা মো. মোজাম্মেল হকের ছেলে মেজর মাহফুজুল হকের জন্ম ১৯৮১ সালের ২১ মার্চ। ২০১৪ সালের ২৮ জানুয়ারি ইউনিটে যোগদান করেন তিনি। পটুয়াখালী জেলার বাউফল থানার সিংহেরাকাঠির বাসিন্দা আবদুস সালামের ছেলে ক্যাপ্টেন তানভীর সালাম শান্তর জন্ম ১৯৯০ সালের ৩০ মার্চ। তিনি ইউনিটে যোগদান করেন ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি। কর্পোরাল মো. আজিজুল হকের গ্রামের বাড়ি ময়মনসিংহ জেলার ইশ্বরগঞ্জ থানার মগলটুলা তরফপাচাই গ্রামে। তার পিতার নাম মো. আমির উদ্দিন। সৈনিক মো. শাহীন আলমের গ্রামের বাড়ি বগুড়া জেলার আদমদীঘি থানার ধনতলা গ্রামে। তার পিতার নাম মো. সরোয়ার হোসেন। সৈনিক মো. আজিজুর রহমানের গ্রামের বাড়ি মাদারীপুর জেলার শ্রীনাথদি বাজিতপুর গ্রামে। তার পিতার নাম খলিল বেপারী।
দুঃসহ বেদনার এই দিনে রাঙামাটি শহরের রূপনগর এলাকার অবুঝ শিশু মীম আর সুমইয়া চিরতরে হারিয়েছে প্রিয় মা, বাবাকে। মীমের বয়স তখন ৪ বছর, সুমাইয়ার ১৮ মাস। বর্তমানে চাচা কাউসারের কোলে ঠাঁই ওদের। আর রাকিব ও ফারিয়া হারিয়েছে বাবাকে। তখন রাকিরে বয়স ৬ বছর আর ফারিয়ার ২ বছর। বাবাকে চিরতরে হারিয়ে রাকিব-ফারিয়ার ঠাঁই অসহায় মা রাবেয়া বেগমের কোলে। প্রকৃতির নিষ্ঠুর থাবায় অবুঝ এই চার শিশুকে হতে হয়েছে অনাথ। ১৩ জুন রাঙামাটিতে পাহাড় ধসে মাটির চাপায় মারা যান মীম-সুমাইয়ার বাবা সালাউদ্দিন ও মা রহিমা বেগম। মারা গেছেন রাকিব ও ফারিয়ার বাবা দরবেশ আলী।
এদিন শহরের ভেভেদী মুসলিম পাড়ার গৃহকত্রী হোসনে আরা আক্তারের সবকিছু কেড়ে নিয়েছে নিষ্ঠুর প্রকৃতি। পাহাড়ের মাটির চাপায় বিলীন হয়ে গেছে তাদের বাড়িঘর। সেখানে মাটির চাপায় প্রাণ গেছে স্বামী আবদুল জলিল (৬০), ছেলে আলমগীর (২৮), ইশতিয়াক আহমেদ টিপু (২০), মেয়ে নরুন্নাহার আক্তার ময়না (২২) ও নাতনি (আলমগীরের মেয়ে) আলিফার (৫)। পরিবারের পাঁচ স্বজন হারিয়ে হোসনে আরা হন পাগলপ্রায়। ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন ৭ জনের পরিবারে কেবল দুইজন। হোসনে আরার আরেক ছেলে আউয়াল হোসেন মোস্তফা (২৪) কাজের জন্য বাইরে থাকায় প্রাণে রক্ষা পান।
স্ত্রী সোনালী চাকমা ও একমাত্র ছেলে অমিয় চাকমাকে (১২) হারিয়ে নির্বাক হয়ে যান রাঙামাটি শহরের ভেদভেদী কিনামনি ঘোনার বাসিন্দা জীবন চাকমা। তিনি সেনাবাহিনীতে চাকরি করেন। স্ত্রী রুপালী চাকমা এবং দুই মেয়ে জুই চাকমা (১২) ও ঝুমঝুমি চাকমাকে (৬) হারিয়ে নির্বাক হয়ে পড়েন, ভেদভেদী যুব উন্নয়ন অফিস সংলগ্ন বসবাসকারী পুলিশের সদস্য সুভাষ চাকমা। সোনালী ও রুপালী দুই বোন। দুর্যোগের দিন বাইরে কর্মস্থলে থাকায় ভাগ্যক্রমে বেঁচে যান জীবন ও সুভাষ। ভয়াল সেই প্রকৃতির ছোবলে ১২০ জনের প্রাণহানিতে চিরতরে প্রিয়জন হারা আজ রাঙামাটির বহু দুর্ভাগা মানুষ। তারা আজ শুধু বয়ে বেড়াচ্ছেন বেদনার স্মৃতিগুলো।
শহরসহ জেলার বিভিন্ন এলাকায় হাজার হাজার মানুষ এখনও বাস করছেন পাহাড় ধসের ঝুঁকি নিয়ে। যাদের যাওয়ার মতো ঠাঁই নেই কোথাও। সরকারের পক্ষে বলা হয়েছে, ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে সরিয়ে নিরাপদ স্থানে বাড়িঘর করে দিয়ে পুনর্বাসন করা হবে। কিন্তু গত এক বছরে এর কোনো প্রক্রিয়া শুরু হতে পারেনি। প্রশাসন বলছে, ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিগ্রস্ত লোকজনকে পুনর্বাসনের চিন্তা আছে সরকারের। কিন্তু শহরের আশেপাশে কোথাও উপযুক্ত জায়গা মিলছে না। তবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর জানমাল রক্ষায় এরই মধ্যে নিরাপদে চলে যেতে বলা হয়েছে।
এরই মধ্যে পাহাড় ধস ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় সচেতনতামূলক প্রচারাভিযান শুরু করেেেছ জেলা প্রশাসন। এলাকায় এলাকায় গিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মতবিনিময় করছেন প্রশাসনিক ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তারা। ঝুঁকিপূর্ণ লোকজনকে স্বেচ্ছায় নিরাপদে চলে যেতে বলা হচ্ছে।
এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক একেএম মামুনুর রশিদ বলেন, ২০১৭ সালের ১৩ জুন পাহাড় ধসের দুর্যোগে রাঙামাটিতে ১২০ জনের প্রাণহানিসহ ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক ২০১৮ সনে নানিয়ারচরে ১১জন মারা গেছে, আমরা আর রাঙামাটিতে এ ধরনের কোনো দুর্যোগে প্রাণহানি চাই না। চাই না ব্যাপক কোনো ক্ষতি। তাই আগের বছরের অভিজ্ঞতার শিক্ষা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় সবাইকে সচেতন হতে হবে।
বিভিন্ন সংস্থার জরিপে বলা হয়েছে অতি বৃষ্টি, বজ্রপাত, জলাবায়ু পরিবর্তন, অপরিকল্পিত বাড়িঘর ও স্থাপনা নির্মাণ, পাহাড় ও বৃক্ষ নিধনসহ বিভিন্ন কারণ পাহাড় ধসের দুর্যোগ ঘটছে। এসব কারণ প্রতিরোধ করে সম্ভাব্য পাহাড় ধস ও দুর্যোগ মোকাবেলার জন্য পাহাড় ও বৃক্ষ নিধন বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ, পরিকল্পিত বাড়িঘর ও স্থাপনা নির্মাণ, ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় বাড়িঘর নির্মাণ ও বসবাসে নিষিদ্ধকরণ, আবহাওয়ার সতর্কীকরণ পূর্বাভাস প্রচার, স্থায়ী ও অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, অবৈধ কাঠ পাচার ও আসবাবপত্র পরিবহন নিয়ন্ত্রণ, দুর্যোগ মোকাবেলা কমিটি গঠন, উদ্ধার কাজের জন্য স্বেচ্ছাসেবক দল গঠন ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন সুপারিশ উঠে আসে এসব প্রতিবেদনে।