প্রকাশঃ ০৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪ ০৮:২৭:০৩
| আপডেটঃ ২৮ নভেম্বর, ২০২৪ ০২:৫২:৩৩
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। হঠাৎ করেই ফের উত্তেজনা বাড়ছে পাহাড়ে। পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলায় পৃথক দুটি ঘটনায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) ছয় কর্মী নিহতের পর এবার রাঙামাটির বাঘাইছড়িতে একই সংগঠনের আরও দুইজন প্রতিপক্ষের গুলিতে নিহত হয়েছেন। এনিয়ে দুই মাসের মাথায় রাঙামাটি-খাগড়াছড়িতে ইউপিডিএফের ৮ নেতাকর্মী খুন হলেন।
খাগড়াছড়ির দুইটি হত্যাকান্ডে ছয়জন খুনের ঘটনায় ইউপিডিএফ ভেঙে গড়ে ওঠা ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)কে দায়ী করলেও এবার রাঙামাটির বাঘাইছড়ি দুই কর্মী হত্যাকান্ডে খোদ সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতিকে দায়ী করেছে ইউপিডিএফ। যদিও প্রতিপক্ষরা এসব অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে আসছেন।
পাহাড়ের রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, পাহাড়ের আঞ্চলিক রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণ হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে ক্রমশ মিত্র হারাচ্ছে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ। ১৯৯৮ সালের ২৬ ডিসেম্বর সন্তু লারমার নেতৃত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ভেঙে আত্মপ্রকাশ করেছিল এই ইউপিডিএফ। প্রতিষ্ঠার পর থেকে পাহাড়ের রাজনীতিকে ধীরে ধীরে ‘প্রভাবশালী’ হয়ে ওঠা এই সংগঠনটি বর্তমানে রাজনৈতিকভাবে ‘নিঃসঙ্গ’ হয়ে পড়েছে।
সর্বশেষ আজ রোববার (৪ ফেব্রুয়ারি) ইউপিডিএফের দুই কর্মী খুনের ঘটনায় থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে ঘটনাস্থল রাঙামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলার মাচালং ব্রিজ পাড়ায়। এলাকাটি আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় উপজেলা বাঘাইছড়ির সাজেক ইউনিয়নে।
রোববারের হত্যাকান্ডের ঘটনায় সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতিকে (জেএসএস) দায়ী করে ইউপিডিএফ রাঙামাটি জেলা সংগঠক সচল চাকমা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘আজ দুপুর ১২টার সময় জেএসএস সন্তু গ্রুপের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা সাজেক ইউনিয়নের মাচালং ব্রিজ পাড়ায় একটি দোকানে এসে অতর্কিতভাবে ইউপিডিএফের দুই সদস্যের ওপর সশস্ত্র হামলা চালায়। সন্ত্রাসীদের এলোপাতাড়ি ব্রাশফায়ারে ঘটনাস্থলে দীপায়ন চাকমা ও আশুক্য চাকমা ওরফে আশীষ নামে দুই ইউপিডিএফ সদস্য নিহত হন।’
তিনি হত্যার ঘটনাকে ‘কাপুরুষোচিত’ ও ‘ন্যাক্কারজনক’ আখ্যায়িত করে বলেন, ‘পার্বত্য চট্টগ্রাামে জুম্ম জনগণের ন্যায্য দাবি আদায়ে ইউপিডিএফের চলমান আন্দোলন বানচাল করে দেয়ার লক্ষ্যে শাসকগোষ্ঠি পরিকল্পিতভাবে সন্তু গ্রুপসহ ঠ্যাঙাড়ে সন্ত্রাসীদের লেলিয়ে দিয়ে প্রতিনিয়ত ইউপিডএফ নেতা-কর্মীদের হত্যা করছে।’
দুই মাসে ৮ খুন:গত বছরের ১১ ডিসেম্বর খাগড়াছড়ির পানছড়ি উপজেলার লোগাং ইউনিয়নের অনিলপাড়ায় গুলি করে ইউপিডিএফের চার নেতাকে হত্যা করা হয়। ওই সময় প্রতিপক্ষের গুলিতে মারা যান ইউপিডিএফের সহযোগী সংগঠন গণতান্ত্রিক যুব ফোরামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিপুল চাকমা, পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের (পিসিপি) কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সুনীল ত্রিপুরা, গণতান্ত্রিক যুব ফোরাম খাগড়াছড়ি জেলা শাখার সহ-সভাপতি লিটন চাকমা ও ইউপিডিএফ সদস্য রুহিন ত্রিপুরা।
পানছড়ির চার খুনের দেড় মাসের মাথায় চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি জেলার মহালছড়ি উপজেলায় আরও দুজনকে হত্যা করা হয়েছিল। তখন মারা যান ইউপিডিএফ সদস্য রবি কুমার চাকমা ও শান্ত চাকমা ওরফে বিমল। সর্বশেষ আজ ৪ ফেব্রæয়ারি রাঙ্গামাটির বাঘাইছড়ি উপজেলায় আরও দুইজন খুন হলেন। নিহত হলেন ইউপিডিএফ সদস্য দীপায়ন চাকমা ও আশুক্য চাকমা ওরফে আশীষ (৪৫) নামের দুই ইউপিডিএফ সদস্য। এনিয়ে দুই মাসের মাথায় পাহাড়ে ইউপিডিএফের ৮ জন মারা গেছেন প্রতিপক্ষের গুলিতে।
রাঙামাটির পুলিশ সুপার মীর আবু তৌহিদ জানিয়েছেন, ‘বাঘাইছড়ির মাচালং এলাকায় নিহত দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। ময়নাতদন্তের জন্য খাগড়াছড়ি জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হচ্ছে। এ ঘটনায় মামলা হবে এবং ঘটনার সঙ্গে যারা জড়িত; তাদের গ্রেফতার করা হবে।’
বাঘাইছড়ির খুনের অভিযোগ অস্বীকার করে জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) বাঘাইছড়ি থানার সাংগঠনিক সম্পাদক ত্রিদিব চাকমা গণমাধ্যমকে জানান, ‘সাজেকে জেএসএসের সাংগঠনিক কোনো কার্যক্রম নেই। ইউপিডিএফের অভিযোগ ভিত্তিহীন।’
এর আগে, খাগড়াছড়ির দুই খুনের ইউপিডিএফ-গণতান্ত্রিক সভাপতি শ্যামল চাকমা বলেছিলেন, পানছড়ি ও মহালছড়িতে ইউপিডিএফ কর্মী হত্যার ঘটনায় তাদের কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল। তিনি ইউপিডিএফের ছয় কর্মী নিহতের ঘটনায় ‘দুঃখপ্রকাশ’ও করেছিলেন।
নেতৃত্বহীন করার জন্য হত্যাকান্ড?ইউনাইটেড পিপলস্ ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) মুখপাত্র অংগ্য মারমা বলেন, ‘আপনারা নিশ্চয়ই জানেন ’৭৫-এ জাতীয় চার নেতা, পাহাড়ে মিঠুন চাকমা, বিপুল চাকমাদের হত্যাকান্ড এই সবই নেতৃত্বাহীন করার উদ্দেশ্যে ঘটিত। জাতিকে নেতৃত্ব শূন্য করতে এসব হত্যাকান্ড চালানো হয়েছে। আমরা যদি পেছন ফিরে দিকে কুমিল্লার তনু হত্যা, পাহাড়ে কল্পনা চাকমা অপহরণসহ রাজনৈতিক নেতাদের হত্যাকান্ডের কোনও বিচার হচ্ছে না। সারাদেশের মত পাহাড়েও বিচারহীনতার অপসংস্কৃতি চলছে।’
অংগ্য মারমা বলেন, ‘ইউপিডিএফের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা-মামলা-খুন অব্যাহত আছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সাধারণ মানুষ ও এখন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। আগে পুলিশ প্রশাসনের প্রতি পাহাড়ের সাধারণ মানুষের কিছুটা আস্থা থাকলেও এখন সেই আস্থা আর নেই। পুলিশও রাষ্ট্রের হয়ে পক্ষপাত করছে। এসব খুন-গুম-হত্যা, নিরাপত্তাহীনতাই বলে দেয় পাহাড়ের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির দিকে।’
২০২৩ সালেও ২৫ ‘হত্যা’:চলতি বছরের ১০ জানুয়ারি ২০২৩ সালজুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে হত্যা, নির্যাতন, অপহরণ ও যৌন সহিংসতার ঘটনায় একটি বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)। ইউপিডিএফ প্রতিবেদনে দাবি করে, ২০২৩ সালে পাহাড়ে বিচারবহির্ভুত হত্যার শিকার হয়েছেন ২৫ জন। এই সময়টাতে গ্রেফতারের শিকার হন ৪৯ জন; শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন ২১ জন; অপহৃত হন ৪৩ জন এবং যৌনসহিসংতার শিকার হয়েছে ২৩ জন নারী-শিশু।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘সমতলের চেয়ে পাহাড়ের বেশি সংখ্যক আইনশৃঙ্খলাবাহিনী নিয়োজিত রয়েছে। তার পরও কদিন পর পরই পাহাড় অশান্ত হয়, হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটে। বলতে গেলে একটা রুটিং ওয়ার্ক হয়ে গেছে। আমরা, সাধারণ মানুষ কেন নিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে? রাষ্ট্রকে এটা আমলে নিতে হবে এবং আন্তরিকভাবে কাজ করতে হবে।’