সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। ঘনিয়ে আসছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটগ্রহণের দিন। ২৯৯ নম্বর রাঙামাটি আসনে শেষ মুহুর্তের নির্বাচনি প্রচারে ব্যস্ত নৌকার প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। তবে এই আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের শক্তিশালী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। যে দুজন প্রার্থী রয়েছেন তাদেরও নির্বাচনি প্রচার তেমন সাড়া জাগানো নয়।
পার্বত্য রাঙামাটি আসনে তিনজন প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন আওয়ামী লীগ মনোনীত নৌকা প্রতীকের প্রার্থী দীপংকর তালুকদার, সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট মনোনীত ছড়ি (লাঠি) প্রতীকের প্রার্থী অমর কুমার দে এবং তৃণমূল বিএনপির মনোনীত সোনালি আঁশ প্রতীকের প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান।
গত ১৭ ডিসেম্বর দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রতীক বরাদ্দের পর ১৮ ডিসেম্বর থেকেই নির্বাচনি প্রচারে নামেন নৌকার প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। মুক্তিজোটের প্রার্থী ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা অমর কুমার দে নির্বাচনি প্রচারে নামেন ২০ ডিসেম্বর থেকেই। তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী প্রচার শুরু করেন তারও পরে। তবে শুরু থেকেই আজ পর্যন্ত জেলার দশ উপজেলায় চষে বেড়াচ্ছেন আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী অমর কুমার দে জেলা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায় যাচ্ছেন ভোট চাইতে। তবে তিনি যাচ্ছেন একা একাই; নেই কোনো কর্মী সমর্থক। অন্যদিকে, তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো. মিজানুর রহমানের নির্বাচনি প্রচার চোখে পড়ার মতো নয়।
গত দশম ও একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটি আসনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) সমর্থিত স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার। ভোটের লড়াইয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী দীপংকর তালুকদারকে হারিয়ে বিজয়ী হয়েছিলেন স্বতন্ত্র প্রার্থী ঊষাতন তালুকদার। তবে একাদশের নির্বাচনে ঊষাতন তালুকদারকে হারিয়ে আসনটি ছিনিয়ে আওয়ামী লীগের দীপংকর তালুকদার।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন নিয়েছিলেন ঊষাতন তালুকদার। শেষাবধি মনোনয়ন প্রত্যাহার করে নেন এই হেভিওয়েট প্রার্থী। ঊষাতনের মনোনয়ন ফরম প্রত্যাহারে রাঙামাটি আসনে ভোট নিরুত্তাপ হয়ে পড়ে মনে করছেন সাধারণ ভোটাররা। এবারের নির্বাচনে ৫ প্রার্থী মনোনয়ন ফরম নিয়েও শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে আছেন তিন জন। ঊষাতন তালুকদার আর জাতীয় পার্টির প্রার্থী হারুনুর রশিদ নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
ঊষাতন তালুকদারের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর 'ফল' হিসেবে অনেকটা ভারমুক্ত হয়েছেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী দীপংকর তালুকদার। তবে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী সরে দাঁড়ানোয় 'জয় নিশ্চিত' এমন ফুরফুরে মেজাজে থেকেও ভোটের দিন কেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতি বাড়ানোকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছে আওয়ামী লীগ। গ্রামে গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা সাধারণ মানুষ থেকে শুরু থেকে সরকারি উপকারভোগী, দলীয় নেতাকর্মীদের ভোটকেন্দ্রে আসার জন্য 'চাপ' দিচ্ছেন। তবে নৌকার প্রার্থীকেই ভোট দিতে হবে এমনটাই নয়; ভোটকেন্দ্রে উপস্থিতি বাড়ানোই তাদের মূললক্ষ্য।
রাঙামাটি জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক মুছা মাতব্বর মনে করেন, রাঙামাটি আসনে এবার আঞ্চলিক দলের সমর্থিত প্রার্থী না থাকায় সাধারণ ট্রাইব্যাল (পাহাড়ি) মানুষের এবার নির্বাচনে কোনো চাপ নেই। সাধারণ পাহাড়িরা আওয়ামী লীগকেই ভোট দেয়, তবে আঞ্চলিক দলের চাপের কারণে অনেকেই ভোট দিতে পারতেন না। তবে ইউপিডিএফ এবার ভোট বর্জন করায় দলটির নেতৃত্বাধীন এলাকার ভোটার উপস্থিতি নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।
মুছা মাতবর বলেন, 'আমরা অবশ্যই এবারের নির্বাচনে ভোটারদের উপস্থিতি বাড়াব। সাধারণ ভোটাররা আমাদের ব্যাপক সাড়া দিচ্ছেন। আমরা দশটি উপজেলা, দুইটি পৌর এলাকায় নির্বাচনি প্রচার চালিয়ে যাচ্ছি।'
তৃণমূল বিএনপির প্রার্থী মো. মিজানুর রহমান বলেন, 'ভোটের পরিবেশ তো নেই। আমার জন্মস্থান রাঙামাটির লংগদু উপজেলায়। কিন্তু আমি এখনো সেখানেই কাজ করতে, প্রচার চালাতে পারিনি। লংগদু উপজেলা হচ্ছে বিএনপির ঘাঁটি। এই উপজেলায় ৬০ হাজার ভোটারের মধ্যে যদি ৪০ হাজার ভোট গ্রহণ করা হয়; তার ৩৫ হাজার পাব আমি, যদি প্রকৃত সুষ্ঠু ভোট হয়। কিন্তু এখন তো ভোটের সুষ্ঠু পরিবেশ নেই। আওয়ামী লীগ সিল মেরে সব ভোট নিয়ে যাবে। সাধারণ মানুষের অধিকাংশই ভোট দিতে আসবেন না। তাদেরও ভোটও নিয়ে যাবে।'
তবে বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রার্থী ও সাবেক আওয়ামী লীগ নেতা অমর কুমার দে'র সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে ফোন কেটে দেন।
এদিকে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ পরিবেশ নেই এমন অভিযোগে ভোট বর্জন করতে সাধারণ ভোটারদের আহবান জানিয়েছে ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট-ইউপিডিএফ। এতে করে প্রসিত খীসার নেতৃত্বাধীন ইউপিডিএফ নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার ভোটারদের ভোটকেন্দ্রে আসা নিয়েও শঙ্কা রয়েছে। যে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকও।
নির্বাচন বর্জনের আহ্বানে ইউপিডিএফ বলেছে, পার্বত্য চট্টগ্রামে বর্তমান পরিস্থিতিতে যেখানে জনগণের ওপর সর্বত্র নিপীড়ন ও খবরদারি বিরাজমান, যেখানে ন্যূনতম গণতান্ত্রিক পরিবেশ নেই, বরং পোষ্য খুনিদের উৎপাতে জনজীবন বিপর্যস্ত এবং যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোকে তাদের স্বাভাবিক গণতান্ত্রিক কাযক্রম চালাতে দেওয়া হচ্ছে না; সেখানে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে না। যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে তা হলো জনগণের সঙ্গে নিষ্ঠুর তামাশা ও প্রহসন, নির্বাচনকে চিরতরে নির্বাসন দেওয়ার জন্য নির্বাচন।নির্বাচন বর্জন কেবল নয়, অন্যদের ভোটদানে বিরত থাকতেও উৎসাহ দিতে বলেছে ইউপিডিএফ। গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি এবং অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সংগ্রামের আহ্বানও জানিয়েছে সংগঠনটি।
তবে নির্বাচন নিয়ে সন্তু লারমার নেতৃত্বাধীন জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) কোনো বিবৃতি কিংবা আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে জানায়নি। দলের সমর্থিত প্রার্থী ও সাবেক সংসদ সদস্য ঊষাতন তালুকদার মনোনয়ন প্রত্যাহারের দিন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, "সারাদেশে ও পাহাড়ে নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ না থাকায় তিনি দলের সিদ্ধান্তে তিনি প্রত্যাহার করে নেন।" এতে করে জনসংহতি সমিতি নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকার ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে আসবেন কিনা; তা নিয়েও রয়েছে শঙ্কা।
জেলার নির্বাচন অফিসের তথ্যমতে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাঙামাটির ১০ উপজেলার দুই পৌরসভাসহ মোট ভোটার সংখ্যা ৪লাখ ৭৪ হাজার ৪৫৪ জন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ২ লাখ ৪৭ হাজার ৪১৬ এবং নারী ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২৭ হাজার ০৩৬ জন।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর শক্তিশালী কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় জয়ের ব্যাপারে আশাবাদী দীপংকর তালুকদারের কর্মী সমর্থকরা কমপক্ষে ৫০ শতাংশ ভোট সংগ্রহের চেষ্টা চালিয়ে যাবে। যে কারণে জয় সুনিশ্চিত বুঝেও ভোটের মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে আওয়ামী লীগ।