এক দশকেও স্থায়ী ক্যাম্পাস পায়নি রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ

প্রকাশঃ ০৩ নভেম্বর, ২০২৩ ০৪:০০:১৩ | আপডেটঃ ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ০৬:১২:২১
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রসারে ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ (রামেক)। প্রতিষ্ঠা পরবর্তী সময়ে ২০১৪-১৫ শিক্ষাবর্ষে অস্থায়ী ক্যাম্পাস হিসেবে প্রথম পাঠদান কার্যক্রম শুরু হয় রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালের করোনারী কেয়ার ইউনিট ভবনে। শিক্ষা কার্যক্রম চালুর পর প্রায় এক দশকেও স্থায়ী ক্যাম্পাস আলোরমুখ দেখেনি। দেশের মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল প্রকল্পের স্থাপত্য কার্যক্রম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ করে থাকলেও রামেকের দায়িত্বে রয়েছে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগ।

এদিকে, রাঙামাটি জেলা শহরের রাঙাপানি এলাকায় ২৬ একর জমি অধিগ্রহন করা হলেও উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা (ডিপিপি) পাশ না হওয়ায় শুরু করা যায়নি স্থায়ী ক্যাম্পাসের নির্মাণকাজ। মেডিকেল কলেজের অবকাঠামোগত সংকট ও শিক্ষা অউপযোগী পরিবেশের প্রভাব পড়েছে শিক্ষার্থীদের ওপর। যে কারণে মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ায় বারবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বদলাচ্ছেন শিক্ষার্থীরা- এমনটাই মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের (রামেক) একাডেমিক শাখা সূত্রে জানা গিয়েছে, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ২০১৪-১৫ সেশনে প্রথম একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হয়। প্রতিটি ব্যাচে ৫১ জন শিক্ষার্থী ভর্তির সুযোগ রয়েছে। আবার ৫১টি আসনের মধ্যে ১৫টি সংরক্ষিত আসন বা কোটা রয়েছে। ১৫টির মধ্যে ১৩টি তিন পার্বত্য জেলার স্থায়ী বাসিন্দা শিক্ষার্থীদের কোটা, একটি মুক্তিযোদ্ধা কোটা ও আরেকটি সমতল অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী কোটা। ১৩টি পার্বত্য কোটার মধ্যে আবার ১০টি ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী শিক্ষার্থী ও ৩টি বাঙালি কিংবা অন্যান্য শিক্ষার্থীদের জন্য। আবার পার্বত্য কোটায় ভর্তি হওয়া ১৩ জন শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে মাইগ্রেশনের কোনো সুযোগ নেই। যদিও বিগত নয়টি ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশন নেওয়ার তথ্যে দেখা ৫১ জন শিক্ষার্থীর আসন থাকলেও দুইটি ব্যাচে সর্বোচ্চ ৪৬ জন ও আরেকটি ব্যাচে ৪৫ জন শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন নিয়ে অন্য মেডিকেল কলেজে বদলি হয়েছেন।

৯টি ব্যাচে মাইগ্রেশন নেয়া তথ্য অনুযায়ী, প্রথম ব্যাচ ২০১৪-১৫ সেশনে ৩৭ জন, দ্বিতীয় ব্যাচ ২০১৫-১৬ সেশনে ৪৬ জন, তৃতীয় ব্যাচ ২০১৬-১৭ সেশনে ১৯ জন, চতুর্থ ব্যাচ ২০১৭-১৮ সেশনে ৪৫ জন, পঞ্চম ব্যাচ ২০১৮-১৯ সেশনে ১২ জন, ষষ্ঠ ব্যাচ ২০১৯-২০ সেশনে ৪৬, সপ্তম ব্যাচ ২০২০-২১ সেশনে ৩৬ জন, অষ্টম ব্যাচ ২০২১-২২ সেশনে ২৬ জন ও সর্বশেষ ২০২২-২৩ সেশনের নবম ব্যাচে ২৮ জন শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন নিয়েছেন। মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ার নিয়ম অনুযায়ী ৫১টি আসনের মধ্যে পার্বত্য তিন জেলার ১৩টি সংরক্ষিত আসনের শিক্ষার্থীরা কেবল মাইগ্রেশন নিতে পারবেন না। সে হিসাবে ৫১ জনের মধ্যে মাইগ্রেশন নিতে পারবেন কেবল ৩৮ জন। কিন্তু  মেডিকেল কলেজের তথ্যে দেখা গিয়েছে, তিনটি ব্যাচেই সর্বোচ্চ ৪৫ ও ৪৬ জন শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন তিনটি ব্যাচেই মাইগ্রেশন নিয়েছেন। মাইগ্রেশনের তিনবার সুযোগ থাকায় প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজে মাইগ্রেশনে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরাও ফের এখান থেকে মাইগ্রেশন নিয়ে অন্যত্র বদলি হয়েছেন।

মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী ও কর্মকর্তারাও মনে করেন, শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশনের ক্ষেত্রে প্রধান কারণ নিজ এলাকার আশপাশের মেডিকেল কলেজের ভর্তি হওয়া বা দূরত্ব কমিয়ে আনা। আবার মেডিকেল কলেজটি প্রতিষ্ঠার পরও এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাস না পাওয়া, আবাসন, লাইব্রেরি সংকটসহ নানার দুর্ভোগ ও শিক্ষাগ্রহণে অপ্রতুল সুযোগ-সুবিধার কারণেও অনেক শিক্ষার্থী মাইগ্রেশন নিয়েছেন। তবে একাডেমিক শাখার কর্মকর্তারা জানান, মাইগ্রেশন নেওয়া শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের র‌্যাংকিং অনুযায়ী যে মেডিকেল থেকে মাইগ্রেশন নিতে চান, তার চেয়ে র‌্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাইগ্রেশনের সুযোগ নেই, কেবলমাত্র মেধাক্রমে নিম্নসারীর মেডিকেল কলেজে মাইগ্রেশনের সুযোগ পান। দেশের অন্যান্য মেডিকেল কলেজ তিন পার্বত্য জেলার বিশেষ কোটা না থাকায় মাইগ্রেশন প্রক্রিয়ার বাহিরে থাকেন পার্বত্য জেলার ১৩টি কোটায় ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীরা।

একাডেমিক শাখা সূত্র জানায়, রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে বর্তমানে ৭৫ শিক্ষক রয়েছেন। প্রতিটি ব্যাচের ৫১ শিক্ষার্থীর বিপরীতে ক্লাস নেওয়ার জন্য রয়েছেন ৭৫ জন শিক্ষক। যে কারণে মেডিকেল কলেজের একাডেমিক সাফল্যগাঁথাও রয়েছে। ২০১৪-২০১৭ সেশন পর্যন্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) অধীনে থাকা অবস্থায় চবির অধীনস্থ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সেরা শিক্ষার্থীদের ১০ র‌্যাংকিং করেছিল উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি। ওই র‌্যাংকিংয়ে ২০১৪-১৫ সেশনে ১ জন, ২০১৫-১৬ সেশনে ২ জন এবং ২০১৬-১৭ সেশনে ২ জনসহ রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের ৫ জন শিক্ষার্থী সেরা ১০ শিক্ষার্থীর তালিকায় ছিল। ওই হিসাবে মেডিকেলে কলেজের একাডেমিক শিক্ষা কার্যক্রমও অন্যান্য মেডিকেলের চেয়ে সন্তোষজনক। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধীনে যাওয়ার পর থেকে র‌্যাংকিং প্রক্রিয়া না হওয়ায় বিগত কয়েকবছরে র‌্যাংকিং তথ্য নেই।

এদিকে, মেডিকেল কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ডা. শহীদ তালুকদার নামে সিভিল সার্জন পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা ২০১৪-২১ সাল পর্যন্ত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন। এরপর ২০২১-২০২৩ পর্যন্ত রাঙামাটির তৎকালীন সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসা অতিরিক্ত দায়িত্বে প্রকল্প পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন। সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খীসার বদলীজনিত কারণে প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পদবি শূন্য হয়ে পড়ে। পরবর্তীতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. অংসুইপ্রæ মারমাকে চলতি বছরের ২৩ জানুয়ারি প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। যদিও নিয়োগপ্রাপ্ত প্রকল্প পরিচালক যোগদান না করায় গত ২০ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরকে লিখিত চিঠি দিয়েছে রামেক। বর্তমানে প্রায় নয় মাস ধরে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প পরিচালক পদটিও শূন্য রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির। নানান সংকটের কারণে রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কার কথা ভাবছেন সংশ্লিষ্টরা।

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের নবম ব্যাচ ও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী সিং এ মং মারমা বলেন, ‘মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়ার পর আমাদের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থা সুযোগ নেই। প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্রাবাস ব্যবস্থা না থাকায় আমাদের থাকতে হচ্ছে আশপাশের বাসাবাড়ি ভাড়া নিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে এখন শিক্ষক সংকট নেই, পর্যাপ্ত ক্লাসও হচ্ছে। এখানে শিক্ষার মান অন্যান্য মেডিকেলের চেয়ে তুলনামূলকভাবে ভালো বলা যায়। মেডিকেলের একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠার চালুর ৯ বছরেও স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে না পারা এবং এটির কোনো অগ্রগতি না থাকা সত্যিই খুবই হতাশার এবং দুঃখজনক বিষয়। বর্তমানে আমাদের মেডিকেল কলেজে যে লাইব্রেরি আছে সেটি সিনিয়ররা পড়াশোনা করতে গেলে আমাদের বাহিরে থাকতে হয়। যদি একটি স্থায়ী ক্যাম্পাস থাকতো সেক্ষেত্রে আমরা বড় লাইব্রেরিসহ পূর্ণ মেডিকেল কলেজের সকল সুযোগ সুবিধা পেতাম। এখন সবকিছু থেকেই বঞ্চিত হচ্ছেন এখানে পড়তে আসা শিক্ষার্থীরা। এছাড়া অন্যান্য মেডিকেলে শিক্ষার্থীদের মেসের খাবারে ভুর্তুকি দেয়া হলেও এখানে সেটি দেয়া হচ্ছে না।’

একই অভিযোগ জানালেন একই বর্ষের শিক্ষার্থী জাকিয়া আফরিন। জাকিয়া বলেন, ‘আমরা এখানকার স্থায়ী হওয়াতে নিজের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করতে পারছি। কিন্তু যারা বিভিন্ন জেলা থেকে পড়াশোনা করতে এসেছেন; তাদের মধ্যে প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের বাহিরেই ভাড়ায় থাকতে হয়। দ্বিতীয় বর্ষের পর থেকে অস্থায়ী হলে সিট পেলেও হলগুলো পুরনো ও জরাজীর্ণ। আবার আশপাশে আবাসিক এলাকা থাকায় হলে চুরি থেকে শুরু করে নিরাপত্তা হুমকি তো আছেই। লাইব্রেরি ছোট হওয়ায় এই সংকটটি এখন বেশি প্রভাব ফেলছে শিক্ষার্থীদের জন্য।’

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা কেবলমাত্র চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে শিক্ষা কার্যক্রম শেষে হাতেকলমে (ইন্টার্নশিপ) শেখার সুযোগ পেলেও বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় ব্যাচ থেকে পরবর্তীতে ব্যাচসমূহের শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নশিপ করতে হচ্ছে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে। সদ্য এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন রাঙ্গামাটি মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী দীপ্ত দাশ তীর্থ, তাকেও ইন্টার্নি করতে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে।

ইন্টার্নিশিপের বিভিন্ন অসংগতির কথা উল্লেখ করে দীপ্ত বলেন, ‘এ পর্যন্ত রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ থেকে চারটি ব্যাচ এমবিবিএস পাশ করেছে। এর মধ্যে আমাদের চতুর্থ ব্যাচে ৪৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে পাশ করেছেন ৩১ জন। আমাদের মেডিকেল কলেজে নিজস্ব হাসপাতাল না থাকার কারণে ইন্টার্নি করতে হবে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে। এমবিবিএস পাশ করার আমাদের হলের সিট বরাদ্দ বাতিল করে দেয়া হয়। সেজন্য আমাদের ইন্টার্নির সময়ে মূল সমস্যার অন্যতম একটি আবাসন। অন্যান্য মেডিকেলে হাসপাতালে ইন্টার্নি ডাক্তারদের জন্য আবাসনের ব্যবস্থা থাকলেও এখানে না থাকায় আমরা যে অর্থ আয় করব সেটি আবাসনের পেছনে খরচ হয়ে যাবে।  রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের হাসপাতালসহ ২৫০ শয্যা হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলমান থাকলেও আমাদের ১০০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে ইন্টার্নি করতে হবে। আসন ও মেডিকেল যন্ত্রাংশ সংকটের এখানকার বেশিরভাগ গুরুতর রোগীকে চট্টগ্রাম পাঠানো হয়। এখানে ভালো অপারেশন থিয়েটার (ওটি) নেই। কোনো আইসিইউ নেই।’

দীপ্ত দাশ আরও বলেন, ‘শিক্ষার দিক দিয়ে রাঙামাটি মেডিকেলে আপাতত কোনো শিক্ষক সংকট নেই। একাডেমিক মান অনেক নামি মেডিকেলের চেয়েও ভালো। আগে ক্লাসরুম সংকট থাকলেও আমাদের আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অস্থায়ী ভবনের ওপরের তলায় আরো কয়েকটি ক্লাসরুম তৈরি করায় ক্লাসরুম সংকট এখন নেই। কিন্তু ফাস্ট ইয়ারের শিক্ষার্থীরা হলের বাহিরে ভাড়া থাকায় তাদের ও ছাত্রী হোস্টেলের শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে। একটি স্থায়ী ক্যাম্পাস হলে একাডেমিক ভবন, হোস্টেলসহ নানান সংকট লাঘব। স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ অনেক জরুরি।’

রাঙামাটি মেডিকেল কলেজের দ্বিতীয় বর্ষের (২০১৫-১৬ সেশন) শিক্ষার্থী ছিলেন অর্ণব বড়ুয়া। তিনি  বলেন, ‘রাঙামাটি মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের সবখানেই দুভার্গ্য। একাডেমিক জীবনে রয়েছে নানান সংকট। উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি চালুর পর নয়টি ব্যাচ ভর্তি হলেও এখনো স্থায়ী ক্যাম্পাসের আলোরমুখ দেখা যায়নি। ২০১৪-১৫ সেশনের একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হলেও দীর্ঘ নয় বছরেও কেন একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ডিপিপি (উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবনা) পাশ হচ্ছে না? স্থায়ী ক্যাম্পাসের অভাবে শিক্ষাজীবন ব্যাহত হচ্ছে দূর-দুরান্ত থেকে আসা শিক্ষার্থীদের।’

তিনি আরো বলেন, ‘এমবিবিএস পাশ করার পর ইন্টার্নি করতে হচ্ছে রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতালে, এই হাসপাতালে অনেক কিছুরই সংকট। সার্জারি বিভাগের নাক, কান, গলা (ইএনটি) ও চোখের অপারেশন ও নিরীক্ষণের জন্য পর্যাপ্ত যন্ত্রপাতি নেই। অনেক সার্জারি যন্ত্রপাতির অভাবে করা যাচ্ছে না। গাইনি, ইএনটি সবমিলিয়ে একটি অপারেশন থিয়েটারের (ওটি) তিনটি বেডে এতগুলো অপারেশন কার্যক্রম চালানো কঠিন। যে কারণে তাড়াহুড়ো করে কাজ করতে গিয়ে অনেক সময় রোগীর শরীরেও ইনফেকশন হয়। আবার কিছু কিছু চিকিৎসা টেস্টের সুযোগ থাকায় ওই রোগী অন্যত্র রেফার করা হয়ে থাকে। আইসিইউ, এন-আইসিইউ নেই। কার্ডিওলজির বিভাগের পিসিইউ সুযোগ থাকায় হার্টএটাকের রোগী সম্পূর্ণ চিকিৎসা নেই। যে কারণে অনেক হার্ডের রোগী চট্টগ্রাম যাওয়ার পথেই মারা যান। শুধুমাত্র আউটডোরে রোগী দেখে ভালো ও মানসম্পন্ন ইন্টার্নি করা যায়।’

এসব প্রসঙ্গে জানতে চাইলে রাঙামাটি মেডিকেল হাসপাতালের অধ্যক্ষ অধ্যাপক প্রীতি প্রসূন বড়ুয়া বলেন, ‘এমবিবিএস পাশ করা শিক্ষার্থীদের ইন্টার্নির ক্ষেত্রে খুব অসুবিধা হচ্ছে না বলা যায়, মোটামুটি ভালোভাবে ইন্টার্নি করা যাচ্ছে। ২০১৪-১৫ সালে একাডেমিক কার্যক্রম চালু হলেও ডিপিপি পাশ হয়নি এটি সত্য। ডিপিপি পাসের বিষয়টি দেখেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।’

বর্তমানে মেডিকেল কলেজের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) পদটি শূন্য থাকার বিষয়টি স্বীকার করেন অধ্যাপক প্রীতি প্রসূন বলেন, ‘আমাদের এখানে এখন প্রকল্প পরিচালকের পদটি শূন্য রয়েছে। সম্প্রতি একজনকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাঁর বর্তমান প্রতিষ্ঠান তাকে রিলিজ না দেয়ায় তিনি এখানে যোগদান করতে পারেননি। আমরা এই বিষয়টি নিয়ে কর্তৃপক্ষকে লিখিত চিঠি দিয়েছি।’

মেডিকেল কলেজে ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশন প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘প্রথম বর্ষে ভর্তির পর তিনবার মাইগ্রেশনের সুযোগে থাকে। মাইগ্রেশনের মূল কারণ প্রত্যেকটি শিক্ষার্থী তার নিজের এলাকার আশপাশের মেডিকেল কলেজেই লেখাপড়া করতে যান। এটিই মাইগ্রেশনের প্রধান কারণ।’

যদিও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের প্রাক্তন সদস্য ও শিক্ষাবিদ নিরূপা দেওয়ান মনে করেন শিক্ষা উপযোগী যে পরিবেশের প্রয়োজন; সেটি না থাকায় এবং পরিবেশ তৈরি কার্যক্রমেরও অগ্রগতি না হওয়ার কারণেই বেশিরভাগ শিক্ষার্থী মাইগ্রেট হয়ে যাচ্ছে। নিরূপা দেওয়ান বলেন, ‘পক্ষে-বিপক্ষে নানান আন্দোলন-দাবির পর পাহাড়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের একটি উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুললো সরকার। কিন্তু প্রতিষ্ঠার পর ভূমি অধিগ্রহণ সম্পন্ন করা হলেও এখনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি আলোর মুখে দেখেনি, স্থায়ী ক্যাম্পাসে যেতে পারেনি। শিক্ষার্থীরা যদি শিক্ষার যুগোপযোগী পরিবেশ না পায় ও ইন্টার্নশিপের পরিবেশ না পায় তাহলে সেটি তো অনেক দুঃখজনক বিষয়। আমি মনে করি শিক্ষা উপযোগী গড়ে না উঠার কারণে এর প্রভাব শিক্ষার্থীদের মাইগ্রেশনে প্রভাব ফেলছে। শিক্ষার্থীরা ভালো পরিবেশ ও উপযোগী ক্যাম্পাস না পেলে তারা কেন এখানে থাকবে? আমরা মনে করি, এটির দিকে সরকারের জোর নজর দেয়া দরকার। অন্যথায় যে উদ্দেশ্য নিয়ে এই উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটি প্রতিষ্ঠা হলো সেই লক্ষ্য বিফলে যাবে।’

প্রসঙ্গত, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে চিকিৎসাসেবা পৌঁছে দিতে ও পাহাড়ে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ার লক্ষ্যে রাঙামাটি মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নেয় সরকার। পাহাড়ের আঞ্চলিক সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (জেএসএস) ও ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্টের (ইউপিডিএফ) তীব্র বিরোধিতা সত্তে¡ও ২০১৪ সালে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির যাত্রা হয়।


সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions