শুক্রবার | ২৯ মার্চ, ২০২৪

কে হচ্ছেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান ?

প্রকাশঃ ০২ মার্চ, ২০২১ ০১:২২:১০ | আপডেটঃ ২৯ মার্চ, ২০২৪ ০৪:৪৭:০৪  |  ১০৮৬৬
বিশেষ প্রতিনিধি, সিএইচটি টুডে ডট কম, রাঙামাটি। কে হচ্ছেন পাহাড়ের অন্যতম শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর চেয়ারম্যান এনিয়ে জল্পনা কল্পনার শেষ নেই। পার্বত্য চট্টগ্রামে বিরাজমান জাতিগত সংঘাত নিরসনে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে পাহাড়ের উন্নয়নের জন্য সরকারি সংস্থা হিসেবে ১৯৭৬ সালের ১৪ জানুয়ারি ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এখানে বছরে প্রায় ১০০/১৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন বরাদ্দ দেয়া হয়। এছাড়া বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য বিশ্বব্যাংক ও ইউএনডিপিসহ উন্নয়ন সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও বরাদ্দ পাওয়া যায়। কিন্তু জনস্বাথের্র এ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানে রাজনৈতিক নেতৃত্বই অনুপস্থিত।

প্রতিষ্ঠার ৪৫ বছরে সাড়ে বত্রিশ বছর ধরে চেয়ারম্যান পদে চট্টগ্রামের বিভাগীয় কমিশনার, সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার ও সরকারি আমলারাই নিয়োগ পেয়েছেন। আর তিন মেয়াদে মাত্র সাড়ে ১২ বছর বেসামরিক পর্ষদে চেয়ারম্যান ছিলেন দুই জনপ্রতিনিধি। অথচ অনির্বাচিত যোগ্য যেকোনো ব্যক্তি উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার ক্ষেত্রে আইনী কোন বাধা নেই।

স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে চেয়ারম্যান না করায় উন্নয়নে যেমনি জনসম্পৃক্ততা বেশি থাকছে না তেমনি জন আকাংখাও পূরণ হচ্ছে না। তাই পাহাড়ের শান্তি, উন্নয়ন, স্বার্থ নিশ্চিত ও প্রতিষ্ঠানটিকে জনবান্ধব করতে হলে পাহাড়ের মানুষকেই দায়িত্বে বসাতে হবে বলে মনে করছেন পাহাড়ের মানুষেরা। সরকারি আমলার পরিবর্তে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব থেকে, উপজাতীয় জনগোষ্ঠির সংখ্যাগরিষ্ঠতার বিচারে চাকমা সম্প্রদায় ও বোর্ডের প্রধান কার্যালয় রাঙামাটি হওয়ায় সেখানকার বাসিন্দা থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ- এই তিন বিবেচনার দাবি উঠেছে।

তারা বলছেন, উন্নয়ন বোর্ডের প্রধান কার্যালয় রাঙামাটিতে হলেও রাঙামাটির বাসিন্দাদের মধ্যে এযাবৎকাল কাউকেই চেয়ারম্যান করা হয়নি। এমনকি জনগোষ্ঠির সংখ্যাগরিষ্টতার বিচারে রাঙামাটিতে চাকমা সম্প্রদায়ের আধিক্য থাকলেও একবারও চাকমা সম্প্রদায় থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়নি। তবে তিন মেয়াদে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বর্তমান মন্ত্রী বান্দরবানের এমপি বীর বাহাদুর উশৈসিং ও খাগড়াছড়ির বিএনপির সাবেক এমপি ওয়াদুদ ভুঁইয়া নিয়োগ পেলেও দু’জনই ছিলেন বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির। সর্বশেষ তিন দফায় নিয়োগ পাওয়া সরকারী আমলা বর্তমান চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরাও খাগড়াছড়ির বাসিন্দা।

প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই ‘উন্নত সমৃদ্ধ পার্বত্য চট্টগ্রাম’ গড়তে এ অঞ্চলের অবকাঠামো ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। বিশেষত যাতায়াত, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, শিক্ষা, কৃষি, সমাজকল্যাণ, ক্রীড়া ও সংস্কৃতি খাতে এবং সমন্বিত সম্প্রদায়ের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের উন্নয়ন ও প্রচারে কাজ করছে।

শুরু থেকেই পদাধিকার বলে বিভাগীয় কমিশনার বা সেনাবাহিনীর চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড এর চেয়ারম্যান ছিলেন। এরমধ্যে ১১ জানুয়ারি ১৯৭৬ থেকে ২ডিসেম্বর ১৯৮৩ পর্যন্ত তিনজন চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার ও ৩ ডিসেম্বর ১৯৮৩ থেকে ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৯৮ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর আটজন চট্টগ্রাম এরিয়া কমান্ডার ছিলেন বোর্ডের চেয়ারম্যান। পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটিতে প্রথম বারের মতো বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি ৭ অক্টোবর ১৯৯৮ থেকে ২২ আগস্ট ২০০১ ও ২৯ মার্চ ২০০৯ থেকে ০১ ডিসেম্বর ২০১৩ এবং ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০০২ থেকে ২২ নভেম্বর ২০০৬ পর্যন্ত ওয়াদুদ ভুঁইয়া চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া ২৩ আগস্ট ২০০১ থেকে ১২ ফেব্রুয়ারি ২০০২ পর্যন্ত এবং ২৩ নভেম্বর ২০০৬ থেকে ২১ মার্চ ২০০৯ পর্যন্ত দুইজন অতিরিক্ত সচিব ও দুইজন মেজর জেনারেল চেয়ারম্যান ছিলেন।

দেশে গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা থাকলেও জনপ্রতিনিধিদের চেয়ারম্যান করার ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। রাষ্ট্রপতির কোটায় অতিরিক্ত সচিব হওয়া পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত মহা-পরিদর্শক নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরা পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়োগ পান।

একইসাথে উন্নয়ন বোর্ডের ‘ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান’ হন। পরে চুক্তিভিত্তিক পূর্ণ দায়িত্ব পান ১৯ ডিসেম্বর ২০১৩ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ পর্যন্ত। সচিব পদে অবসর নেয়ায় ১৯ মার্চ ২০১৮ তারিখে পুনরায় তিনি সচিব মর্যাদায় তিন বছরের জন্য নিয়োগ পান। এই মার্চেই চুক্তির মেয়াদ শেষ হচ্ছে। তাই এরইমধ্যে উন্নয়ন বোর্ডের চেয়ারম্যান হতে তোড়জোড় শুরু করেছেন অনেকেই।

তবে বর্তমান চেয়ারম্যান নব বিক্রম কিশোর ত্রিপুরার আমলে বোর্ডে বরাদ্দ দ্বিগুণ, সৃজনশীল কর্মের পাশাপাশি কাজে গতিশীলতা ফিরে এসেছে।
 
পাহাড়ের এ উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানটির আগামী চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়োগ পেতে রাঙামাটি জেলা আওয়ামীলীগের দুই সহসভাপতি ও রাঙামাটি জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান নিখিল কুমার চাকমা ও চিংকিউ রোয়াজার নাম শোনা যাচ্ছে। তবে পাহাড়ি-বাঙালী জনগোষ্ঠির মাঝে নিখিল কুমার চাকমার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি রাঙামাটি পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান থাকাকালীন সময়ে সকল জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের কাজ করেছেন। এছাড়া খাগড়াছড়ির সংসদ সদস্য কুজেন্দ্র লাল ত্রিপুরা ও খাগড়াছড়ির মহিলা এমপি বাসন্তি চাকমাও নানা মহলে তদবির করছেন। আবার তথ্য কমিশনের চেয়ারম্যান সুদত্ত চাকমাকেও একটি মহল চেয়ারম্যান করার চেষ্টা করছেন বলে শোনা যাচ্ছে, তিনিও সরকারি আমলা।

দীর্ঘকাল ধরে ‘স্থানীয় রেওয়াজ’ অনুসরণ করা হয়েছে তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়ার ক্ষেত্রে। চাকমা অধ্যুষিত রাঙামাটিতে চাকমা, ত্রিপুরা অধ্যুষিত খাগড়াছড়িতে ত্রিপুরা, ও মারমা অধ্যুষিত বান্দরবানে মারমা সম্প্রদায় থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এমনিক জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও দল আওয়ামীলীগ এই রীতি অনুসরণ করে আসছে। কিন্তু এবার সেই রীতি ভেঙে সম্প্রতি পুনর্গঠিত তিন পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া হয়েছে মারমা সম্প্রদায় থেকে। ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাকমা ও ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সঞ্চার হয়েছে ক্ষোভের।

পার্বত্য চট্টগ্রামের বর্ষিয়ান সাংবাদিক সুনীল কান্তি দে বলেন,‘পার্বত্যবাসী মনে করে প্রতিষ্ঠানটিকে জনবান্ধব করতে হলে জন প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে জন প্রতিনিধিত্ব হওয়া উচিৎ’।

রাঙামাটি জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটি(দুপ্রক)’র সাধারণ সম্পাদক ললিত চন্দ্র চাকমা বলেন,‘জেলা পরিষদে নিয়োগ দিয়েছে সরকার, কিন্তু আরও যোগ্যতাসম্পন্ন মানুষ ছিল, সেটা হয় নাই। বান্দরবান, খাগড়াছড়ি থেকে উন্নয়ন বোর্ডে চেয়ারম্যান হলেও রাঙামাটিতে এপর্যন্ত দেওয়া হয় নাই। সরকার বিষয়টি খতিয়ে দেখুক’।  

শিক্ষাবিদ ও জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সাবেক সদস্য নিরূপা দেওয়ান বলেন,‘মনোনীত ব্যক্তিদের জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা নেই। পাহাড়ে সব প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন দরকার। বোর্ডেরও নির্বাচন দরকার। বর্তমান চেয়ারম্যানের আমলে পাহাড়ে কিছুটা হলেও দৃশ্যমান উন্নয়ন দেখা গেছে। এটি অব্যাহত রাখতে যোগ্য ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান করতে হবে’।

আওয়ামীলীগ নেতা ও রাঙামাটির আইনজীবী অ্যাডভোকেট বিপ্লব চাকমা বলেন,‘জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকদের জন্য উন্নয়ন বোর্ড। আমলারা দায়িত্বে থাকলে সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক কর্মীরা ঘেঁষতে পারে না। আমলাদের জনসম্পৃক্ততা নেই। তাই জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিকদের মধ্য থেকে চেয়ারম্যান নিয়োগ দেয়া এখন সময়ের দাবি’।


বিশেষ প্রতিবেদন |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions