মঙ্গলবার | ১৯ মার্চ, ২০২৪

প্রসঙ্গ: পাহাড়ের উত্তপ্ত পরিবেশ : প্রদীপ চৌধুরী

প্রকাশঃ ২৭ অগাস্ট, ২০১৯ ১২:৩০:৩৮ | আপডেটঃ ১৫ মার্চ, ২০২৪ ০৭:৫৮:৩৬  |  ৪৬৩৪
বিশ্বের অন্যতম গ্রহণযোগ্য গণমাধ্যম ‘বিবিসি’ তাঁদের বাংলা মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে পার্বত্যাঞ্চলে সংঘটিত সন্ত্রাসী কার্যক্রম নিয়ে আজ (২৭ আগস্ট) একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। দিনের শেষ বেলায় নিশ্চয়ই এটি এরিমধ্যে লক্ষ কোটি মানুষের নজর ছুঁয়ে গেছে।
‘বিবিসি বাংলা’ পার্বত্য চট্টগ্রামের সাম্প্রতিক পরিবেশ নিয়ে তাঁদের বেশকটি প্রতিবেদনে বান্দরবান-রাঙামাটি ও মিয়ানমার সীমান্তে সন্ত্রাসী হামলায় একজন নবীন সৈনিকের মর্মান্তিক মৃত্যু’র পর পরই রাঙামাটির বাঘাইহাট ও খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলায় আরো চার বেসামরিক ব্যক্তির অপমৃত্যু’র ঘটনাকে গুরুত্বসহ বিশ্লেষণ করেছে।

এই আগস্ট থেকে পেছনের দিকের একবছর ধরলে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটিতে দুই দফায় একসাথে সাত সাত জনের রাজনৈতিক অপমৃত্যু’র দুটি ঘটনা দেশে-বিদেশে রীতিমতো পিলে চমকে দেয়ার মতোই ছিল। তার একটু আগে খাগড়াছড়ি-রাঙামাটি সীমান্তবর্তী বেতছড়ি এলাকাতেও একসাথে ছয় জনের রাজনৈতিক মৃত্যু’র ঘটনাও বেশ আলোড়িত করেছিল একই রকমভাবে।

বলা চলে নভেম্বর ২০১৭ থেকে আগস্ট ২০১৯, এই একুশ মাসে বিশেষ করে খাগড়াছড়ি’র নয় উপজেলা ও রাঙামাটি জেলার বাঘাইছড়ি, লংগদু, নানিয়ারচর ও বরকল উপজেলা মিলে প্রায় অর্ধশত রাজনৈতিক খুনোখুনির ঘটনা ঘটেছে। একই সময়ে আঞ্চলিক দলের সাথে ক্ষমতাসীন সরকার দলের বিরোধের উত্তাপ ছড়িয়েছে রাঙামাটি ও বান্দরবানেও। তাতেও উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতাকর্মীর অনাকাঙ্খিত প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
‘বিবিসি’র একজন প্রতিবেদককে বান্দরবানের ‘দ্য ডেইলি স্টার’ প্রতিনিধি-সাংবাদিক সঞ্জয় কুমার বড়–য়া বলেছেন, পাহাড়ে যেসব হত্যাকান্ড হয়েছে সাধারণত সেগুলোর বিচার হতে দেখা যায় না।

এটি একটি নিরেট সত্য। তার পেছনের কথাই ফিরে যায়। ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ যেটি সবার কাছে ‘শান্তিচুক্তি’ নামেই পরিচিত। ১৯৯৭ সালের ডিসেম্বরে বর্তমান সরকার প্রধান এবং ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি (পিসিজেএসএস)’ ও পরে ‘আঞ্চলিক পরিষদ’ প্রধান সন্তু লারমা’র সাথে স্বাক্ষরিত হয়েছিল। সে চুক্তি’র সাথে দ্বিমতের সূত্র ধরে ১৯৯৮ সালে এক বছরের মাথায় ‘ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ)’, ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সময়কালে ‘পিসিজেএসএস (এম. এন. লারমা) এবং ২০১৭ সালের ১৫ নভেম্বর ‘ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’-এর প্রকাশ ঘটে। বর্তমানে এই চারটি রাজনৈতিক দল নামধারী পক্ষের হাতে পাহাড়িদের সিংহভাগ মানুষ মূলত: জিম্মি। এই চারটি দলের চাঁদাবাজির শিকার বাঙালি ব্যবসায়ীরাও।

সেই ‘শান্তিচুক্তি’র পর থেকে তিন পার্বত্য জেলায় নিরবিচ্ছিন্নভাবে পাহাড়িদের মধ্যে অভ্যন্তরীণ রক্তক্ষরণ লেগেই আছে। কে কখন মারা যাবেন বা অপহরণ হবেন, তার কোন কার্যকারণ কেউ-ই নির্ধারণ করতে পারেন না। ‘বিবিসি বাংলা’র প্রতিবেদনে ঠিকই বলা হয়েছে, খাগড়াছড়িতেই শান্তিচুক্তি বিরোধী বা এই চুক্তি’র সাথে দ্বিমত পোষনকারী ‘ইউপিডিএফ’র অবস্থান ভালো। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অনুষ্ঠিত অষ্টম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমবারের মতো খাগড়াছড়ি ২৯৮নং সংসদীয় আসনে ‘ইউপিডিএফ’ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। পার্বত্য শান্তিচুক্তি’র উছিলায় স্থায়ী বাসিন্দাদের নিয়ে ভোটার তালিকা প্রণয়নের প্রশ্নে সে নির্বাচন সশস্ত্র পন্থায় বর্জনের পথে ছিল শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরকারী সন্তু লারমা’র নেতৃত্বাধীন ‘পিসিজেএসএস’। প্রথম নির্বাচনেই বেশ ভালো ভোট পেয়ে ‘ইউপিডিএফ’ প্রধান প্রসিত বিকাশ খীসা দেশ-বিদেশকে তাক লাগিয়ে দেন।
সেই নির্বাচনের পরে তিনি যেমন আড়ালে চলে যান, একই সাথে খাগড়াছড়িতেও ক্রমশ: কমতে থাকে ‘পিসিজেএসএস’-এর আধিপত্য। ‘ওয়ান-ইলেভেন’ সময়কালে ‘পিসিজেএসএস’র বিভক্ত একটি অংশ ‘পিসিজেএসএস (এম. এন. লারমা)’ নামে ‘ইউপিডিএফ’-এর সাথে ঘাঁটছড়া বাঁধে। যা সর্বশেষ ২০১৭ সালের নভেম্বরে ‘ইউপিডিএফ (গণতান্ত্রিক)’ অংশের সাথে মিলে পুরোনো মিত্র ‘ইউপিডিএফ (প্রসিত বিকাশ খীসা)’-এর নেতৃত্বের সাথে সশস্ত্র বিরোধে জড়িয়ে পড়ে।

তাহলে একটি বিষয় তো পানির মতো পরিস্কার যে, একপক্ষ, দুইপক্ষ, তিনপক্ষ এবং চারপক্ষ; সব আমলেই তাঁরা সশস্ত্র তৎপরতাতেই ব্যস্ত ছিলেন। কখনো কম, কখনো বেশি, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির পথেই ব্যস্ত ছিলেন সব পক্ষই সমানতালে।

কৌশলগত কারণে কোন কোন পক্ষ বিদ্যমান সরকারের প্রতি আপাত: বশ্যতা প্রদর্শন করলেও সময়ের সাথে সাথে সব পক্ষই পাল্টে যাচ্ছেন। এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে জননিরাপত্তার জন্য বড়ো ধরনের হুমকি সৃষ্টি করছেন। দেশের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশজুড়ে এ ধরনের নৈরাজ্য স্থানীয় প্রশাসনকে যেমন প্রশ্নবিদ্ধ করে, একই সাথে বর্হিবিশে^ও দেশের ভাবজগতকে বেকায়দায় ফেলে। তাই সময় বেশি না গড়াতেই এসব বিপথগামী পক্ষগুলোর লাগাম টানা জরুরী। অথবা তাঁদের নিজেদের স্বার্থেই সংযত হওয়া প্রয়োজন।

প্রশ্ন আসতেই পারে, কী ভাবে তা সম্ভব? প্রথমত: পার্বত্য চট্টগ্রাম এখন দেশের কোন মূলধারা থেকে বিচ্ছিন্ন কোন জনপদ নয়। সমতলের সাথে তুলনা করলে গত দুই দশকে তিন পার্বত্য জেলা উন্নয়নের সবখাতে ভালোই এগিয়েছে। প্রশাসন বিকেন্দ্রীকরণের ক্ষেত্রে যদি বলা হয়, তাহলে সে নিক্তি অনেক উপরে। টানা তিন মেয়াদে থাকা বর্তমান সরকারের আমলে এখানে সরকারি বরাদ্দের পরিমাণ বেড়েছে অপ্রত্যাশিত। এখানকার মানুষের যোগ্যতা অনুযায়ী ক্ষমতায়ন-কর্মসংস্থান এবং সমৃদ্ধি কোন অংশেই সমতলের অন্য সব জেলার চেয়ে কম নয়।

তাহলে কেনো এমন অরাজক অবস্থা বিরাজ করছে? গত দুই দশককে পার্বত্য তিন জেলার বাসিন্দাদের জন্য একটি আশা প্রদ সময়ই হবার কথা। কারো কারো জন্য তার চেয়েও বেশি হবার কথা। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা বিশ্লেষণ করার মতো সরকারি বা বেসরকারি কাঠামোর অনুপস্থিতিতে অবৈধ অস্ত্রধারীরাই এখানে বার বার জননিয়ামক হয়ে উঠছেন। আর যখনি এমন অগণতান্ত্রিক শক্তির আস্ফালন ঘটছে তখনিই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে দায়িত্বের খাতিরেই কঠোর ভূমিকায় নামতে দেখা যাচ্ছে। পরিস্থিতিটা যদি আইন-শৃঙ্খলাজনিত হয় তখন তো আর গাছ থেকে আলাদা করে ‘একটি পাকা আম’ পেরে খাবার সুযোগ থাকে না।

বিগত দুইটি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি আসনে মূলধারার রাজনৈতিক দল হিসেবে ‘আওয়ামীলীগ’-এর নেতাকর্মীদেরকে রীতিমতো ভীতিকর অবস্থায় পড়তে হয়ছে। অথচ, আদর্শিক দিক থেকে আঞ্চলিক দলগুলোর সাথে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাচীনতম এই দলটির কোনই বিরোধ থাকার কথা নয়। কিন্তু, অবৈধ-অদৃশ্য এবং অনৈতিক জোরজবরদস্তির মাধ্যমে সাধারণ পাহাড়িরা জিম্মি থাকতে বাধ্য হয়েছেন। বেশিরভাগ পাহাড়ি অধ্যুষিত এলাকাতে মানুষ স্বাধীনভাবে ভোটকেন্দ্রে পর্যন্ত যেতে পারেন নি। তার বিরুপ প্রভাবের শিকার হচ্ছেন সব মানুষই।
তিন পার্বত্য জেলায় যাঁরা আঞ্চলিক রাজনৈতিক দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে অনেকে দেশসেরা উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকেই সুশিক্ষিত। অনেকের রয়েছে বর্ণাঢ্য ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস। তাঁদের অনেকের পঠন-পাঠনের পরিধিও অসীম ব্যাপক। তবুও কোথাও জানি একটা গলদ, বার বার হোঁচট খাইয়ে দিচ্ছে পাহাড়ের রাজনীতিকে। জেএসএসকে ভালো না লাগলে ইউপিডিএফ করতে হবে, জেএসএস-এমএন লারমা কিংবা গণতান্ত্রিক হয়ে অন্ধকার পথে পা বাড়াতে হবে; এমন তো কোন কথা নেই। হয়তো ধরেই নিলাম, আওয়ামীলীগ খারাপ; তাই বলে কী বিএনপিও করা যাবে না? অথবা দলত্যাগ করলেই ‘মৃত্যু পরোয়ানা’ জারির এই সংস্কৃতি কী অদূর ভবিষ্যতে টিকে থাকবে? নিশ্চয় না।

সময় থাকতে সঠিক পথের নিশানা ঠিক করতে না পারলে, পরবর্তী প্রজন্ম কাউকে ক্ষমা করবে না। তিরিশ লক্ষ শহীদ আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশর মানুষ ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম’কে একই মানচিত্রই মনে করে। উনিশ’শ একাত্তর সালে জাতির পিতা’র তর্জনী কাঁপুনিতে নয় মাসের যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম হয়েছে, সেই সংগ্রামের সোনালি ফসল এই ছাপ্পানো হাজার বর্গমাইলের সবুজ জমিন ‘প্রিয় বাংলাদেশ’।
জাতি-ধর্ম-বর্ণ-ভাষা-সংস্কৃতি নির্বিশেষে একই মায়ের অভিন্ন সন্তান হিসেবেই আমাদের বেড়ে উঠতে হবে। সেই স্বপ্নকে ধারণ করেই বিশ্বের অন্যতম নান্দনিক নেতা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের পরিণত করেছেন। এই অগ্রযাত্রায় পাহাড়ের মানুষও শামিল হয়েছেন। আর যাঁরা দিনের আলোতেও অন্ধকারকেই বেশি ভালোবাসছেন, পাহাড়ের মেধাবী সন্তানদের ভুল পথে পরিচালিত করছেন, দিনের শেষে-জীবনের শেষে আপনারা ‘ধুয়ো তুলসী পাতা’ থেকে যাবেন; এটি মনে করা মহা বোকামি হবে।


প্রদীপ চৌধুরী: সংবাদকর্মী।


মুক্তমত |  আরও খবর
এইমাত্র পাওয়া
আর্কাইভ
সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত, ২০১৭-২০১৮।    Design & developed by: Ribeng IT Solutions